কিছু অপ্রিয় সত্য বলতেই হবে

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘ইস্তাহারে যে অঙ্গীকার ছিল, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে, তার নব্বই শতাংশই করে দিয়েছি’।

Advertisement

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
Share:

তোষণ বনাম উন্নয়নের বিতর্কে কিছু ধূসর অঞ্চলও আছে। যেমন ‘সংরক্ষণ’। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পর রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ১২টির বদলে ৪৯টি মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’র তালিকায় (ওবিসি) অন্তর্ভুক্ত করে দেন। যার ফলে এক ধাক্কায় রাজ্যের মুসলিমদের ৮৬ শতাংশ সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের আওতায় চলে আসেন। লক্ষণীয়, সাচার কমিটির রিপোর্টেই দেখা গিয়েছিল এ-রাজ্যের মুসলিম শিশুদের মাত্র ৫০ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পায়, তাদের মধ্যে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হয় মাত্র ১২ শতাংশ। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষার হাল যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রকম, তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ কোন কাজে লাগবে? ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, সমস্ত সরকারি চাকরিতেই আজ মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত পদগুলি ফাঁকাই পড়ে থাকে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ পরীক্ষাগুলির ফলাফলের দিকে তাকালেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিজ্ঞানের সমস্ত বিষয়েই মুসলিম ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষিত পদগুলিতে শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না।

Advertisement

একটি রাজ্যের জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশ বাহিনীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মী ঠিক অনুপাতে থাকা ভয়ংকর জরুরি। যে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হয়। অথচ যে রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মুসলমান, সেই পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ-বিভাগে মুসলিম কর্মী রয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। এই ‘প্রাতিষ্ঠানিক সাম্প্রদায়িকতা’ এ-রাজ্যের সমস্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেই প্রকট। (রাজ্যের সাড়ে তিন লক্ষ সরকারি কর্মচারীর ৫.৪৭ শতাংশ মুসলমান।) কাজেই বোঝা যাচ্ছে, একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সামনে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের গাজর ঝুলিয়ে দিলে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু ভোট হয়তো জুটে যায়, কিন্তু ওটা গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার নীতি, যা তোষণেরই নামান্তর।

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘ইস্তাহারে যে অঙ্গীকার ছিল, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে, তার নব্বই শতাংশই করে দিয়েছি’। অথচ তারও পাক্কা পাঁচ বছর পর, ২০১৬ সালে, স্ন্যাপ, গাইডেন্স গিল্ড এবং প্রতীচী ট্রাস্টের যৌথ ভাবে করা সমীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়ে দিয়েছিল, ‘পরিবর্তিত’ পশ্চিমবঙ্গেও মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি। অমর্ত্য সেনের হাত দিয়ে প্রকাশিত সেই রিপোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছিল, একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে যা সবার আগে দরকার, সেই ফরমাল এডুকেশন বা আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ব্যাপারেই এই সরকারের এখনও অনেক কিছু ভাবার ও করার আছে। এখন ৫০ শতাংশের বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিগমের থেকে ‘মাইনরিটি স্কলারশিপ’ দেওয়া হয়। বৃত্তি নয়, দরকার অনুদান। এবং মেধার বিচার না করে সকলকেই তা দেওয়া উচিত। কারণ, মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে দারিদ্র তুলনায় বেশি এবং দারিদ্রই মেধার বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায়। পাশাপাশি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য উচ্চ শিক্ষায় অধিক সংরক্ষণ ও আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা দরকার।

Advertisement

অপ্রিয় হলেও আর একটি সত্য কথা না বললেই নয়। মাদ্রাসা শিক্ষায় টাকা ঢালার বদলে ‘আল-আমিন মিশন’-এর মতো ট্রাস্টকে (যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের ধর্মশিক্ষার বদলে বিজ্ঞান শিক্ষার দিকে বেশি এগিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে) আর্থিক ভাবে পুষ্ট করা বেশি দরকার। পশ্চিমবঙ্গে বেশির ভাগ উচ্চ-মাধ্যমিক মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ নেই, নেই গ্রন্থাগার বা গবেষণাগার। পরিকাঠামোর এই ঘাটতিগুলোর দিকে অনেক বেশি নজর দিতে হবে। বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও শিক্ষাব্রতী মীরাতুন নাহার ‘পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন’ প্রবন্ধে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘বৈষম্যসাধনকারী শিক্ষাব্যবস্থা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘শিশু বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের বীজ বপন করা হলে তার অনিবার্য ফল হয় ঐক্যবোধের ফাটল। জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে ধ্বংস ডেকে আনার এই প্রক্রিয়া শাসকদের শোষণনীতির সহায়ক কিন্তু দেশের সার্বিক কল্যাণ সাধনের পক্ষে বিপজ্জনক।’ কথাগুলি মূল্যবান, সে বিষয়ে সংশয় থাকতে পারে না। অথচ মূলধারার শিক্ষা-কাঠামোকে শক্তিশালী করার বদলে এই সরকার থেকে অনুমোদনহীন দশ হাজার মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বাহবা কুড়নো হয়েছে। একটি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগকে ব্যবহার করে ভোটব্যাংক সুরক্ষিত করার এই পদ্ধতিটিকেই কিন্তু ‘তোষণ’ বলা হয়।

দারিদ্র দূরীকরণে ও শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর গৃহীত বেশ কিছু পদক্ষেপে কিন্তু সত্যিই যাবতীয় ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পক্ষপাতের ওপরে যাওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায়। দু’টাকা কিলো দরে চাল বা নিখরচায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা, কন্যাশ্রী, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, ইউনিফরম বিলি, সবুজ সাথী ইত্যাদি উদ্যোগের মধ্যে একটা সমাজতান্ত্রিক মডেল চোখে পড়ে। এ-সবের পাশাপাশি কিন্তু তাঁকে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় ভাবাবেগকে সুড়সুড়ি দেয় এমন সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে লাগাম দিতেই হবে। এবং রাজ্যের সব মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নকেই পাখির চোখ করতে হবে। অন্যের দেখাদেখি কখনও হনুমান পূজা, কখনও বা তিন তালাকের সমর্থনে সভা করলে বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকেই তা পরোক্ষে ইন্ধন জোগাবে। জোগাচ্ছেও।

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement