তিন বছরের শিশু কি বুলেটের ভাষা পড়তে পারে? সে কি জানে, ওই বুলেটের শব্দ কণ্ঠরোধ করছে তারই দাদুর মতো আরও অনেক মানুষের, প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে? েসই দাদু, বশির আহমেদ খান, হয়তো তার কিছু আগেই, শ্রীনগর থেকে বারামুলা জেলার সোপোরে আসার পথে গাড়িতে গল্প করতে করতে এসেছেন প্রিয় নাতির সঙ্গে। সোপোরে পৌঁছে পড়ে গিয়েছেন জঙ্গি-সিআরপিএফ গুলির লড়াইয়ের মধ্যে। গাড়ি ঘোরাতে চেয়েও পারেননি বশির। বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে তাঁকে। তাঁর নিথর দেহের ওপর বসে কাঁদছে ছোট্ট ছেলেিট, এই ছবি ভাইরাল হল।
বশির আহমেদ খানের ছেলে অভিযোগ করেছেন, তাঁর বাবাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে গুলি করে মেরেছে নিরাপত্তা বাহিনী। সিআরপিএফ পাল্টা বলেছে, বশিরকে মেরেছে জঙ্গিরাই। এই উপত্যকায় আসলে যে কোন পক্ষের বুলেট কখন কার প্রাণ কাড়ে, সেটাও তো এক মস্ত ধাঁধা!
কিছু দিন আগের ঘটনা। ২৩ বছরের যুবক পির মেরাজুদ্দিন তাঁর কাকা গুলাম হুসেন শাহকে অফিসে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন। বদগাম জেলার মাখামা গ্রাম থেকে শ্রীনগরের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। হ্যাঁ, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, কারণ গুলাম জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের এক জন সহকারী সাব ইনস্পেক্টর। তাঁর ডিউটি কন্ট্রোল রুমে। শ্রীনগর-গুলমার্গ হাইওয়ে ধরে কাকাকে তাঁর কর্মস্থলে সময়ে পৌঁছে দিতে একটু দ্রুত গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন পির। গুলাম জানিয়েছেন, প্রথম নাকা চেকিংয়ের সময় তিনি তাঁর পরিচয়পত্র দেখালে পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়। পরের নাকা চেকিংয়ে প্রহরারত সিআরপিএফ জওয়ানকে ওই পুলিশকর্মী সিগন্যালও দিয়ে দেন। কিন্তু গুলামের অভিযোগ, পরের চেকপয়েন্টে আগে থেকেই এক সিআরপিএফ জওয়ান তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছিলেন। তাঁরা সেখানে গাড়ি থামান। কিন্তু কোনও কিছু বলার আগেই ওই জওয়ান তাঁর ভাইপোকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দেন।
গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে থাকেন কাকা। সে সময় কয়েক জন সিআরপিএফ জওয়ান এগিয়ে এসে একটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁদের হাসপাতালে পাঠান। তত ক্ষণে সব শেষ। এর পর বিবৃতি দিয়ে পিরের কাকা গুলামের ভাষ্য খণ্ডন করে সিআরপিএফ পাল্টা দাবি করে, পির একটি চেকপয়েন্ট ভেঙে এগিয়ে এসে আরও একটি চেকপয়েন্ট উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিলেন। তাঁদের বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও তাঁরা শোনেননি। তখনই ওই জওয়ান গুলি চালান। গুলি চালকের বাঁ কাঁধে লাগে। আলাদা বিবৃতিতে পুলিশও একই ভাষ্য দেয়। জানানো হয়, তদন্ত শুরু হয়েছে।
ভয়ের কথা শুনতে শুনতে, একটানা শুনতে শুনতে কখন যে ভয়টা ফিকে হতে থাকে, বলা মুশকিল। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত যে, অষ্টপ্রহর চোখের সামনে ভয়ের চাদর ঝুলিয়ে রাখলে সে চাদরের গাঢ় রং বিবর্ণ হতে থাকে, যাদের জন্য সেই আবহ তৈরি করা, তারা ভয়ের চোখে চোখ রেখে ঠিক কখন যে এক পা এক পা করে এগোতে শুরু করে সেটাও হলফ করে বলা কঠিন।
গোটা দেশের সঙ্গে সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরেও এখন আনলক পর্ব চলছে। কিছু ক্ষেত্রে ছাড় আছে বিধিনিষেধ মেনে। কিন্তু, ছাড় তো বহিরঙ্গে! অন্তরের অবরোধ কবে উঠবে কাশ্মীরে? করোনাভাইরাস ঢাল মাত্র, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কাশ্মীরিরা তো অলিখিত এক লকডাউনের আওতাতেই রয়েছেন!
সীমান্তে এখন যুদ্ধের বাদ্যি। এ সময়ে অবরুদ্ধ কাশ্মীরের প্রসঙ্গ ফের টেনে আনা কেন? বিশেষ করে যেখানে কাশ্মীরিরা ২০১৯-এর ৫ অগস্ট থেকে লকডাউনের মধ্যেই দিনাতিপাত করছেন?
মনে রাখতে হবে, দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা ও তাঁর পুত্র ওমর আবদুল্লা ছাড়া পেলেও আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এখনও বন্দি। উপত্যকার অসংখ্য সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, বিদ্বজ্জন, হাজার হাজার যুবক কারাবন্দি। কাশ্মীরের ভয়ঙ্কর জনসুরক্ষা আইনের (পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট) প্রয়োগ করা হচ্ছে নির্বিচারে। ধৃতদের হয় রাজ্যে অথবা রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উপত্যকার বহু মানুষ কোথায় বন্দি রয়েছেন, কোন রাজ্যের কোন জেলে ঠাঁই হয়েছে তাঁদের, তা জানতে পারছেন না বাড়ির লোকজনও। মহিলা চিত্রগ্রাহকের বিরুদ্ধেও অনায়াসে প্রয়োগ করা হচ্ছে ইউএপিএ-র মতো আইন। এই আইনে অনায়াসে দু’বছর পর্যন্ত জেলবন্দি করে রাখা যেতে পারে অভিযুক্তদের। গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে যাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাঁদের সন্ধানে পরের দিন ভোরে থানায় হত্যে দিচ্ছেন বাড়ির লোকরা। সেখানে গিয়ে শুনতে হচ্ছে, ছেলে এখানে নেই। বাড়ি ফিরে যাও। ছেলের খবর পেলে দেব।
কী খবর দেবে ভূস্বর্গ? লক... আনলক... লক... আনলক... এই ভুলভুলাইয়ায় ঘুরে মরছে কাশ্মীর! তাণ্ডবনৃত্যের এই কালে দাদুর দেহের উপরে ছাড়া আয়াদরা কাঁদবে কোথায়?