ফরাসি দার্শনিক মরিস ব্লাঁশো তাঁর ‘স্পেস অব লিটারেচার’ প্রবন্ধে সাহিত্যিক বা লেখকের পরিসর বিষয়ে একটা ভারী চমৎকার চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখছেন কী ভাবে সাহিত্যিক সর্বদাই রয়েছেন এক রকম নির্বাসনে। হেঁটে বেড়াচ্ছেন একটা জনহীন মরুভূমির ভিতর। এই মরুভূমিকে ব্লাঁশো বলছেন একটা ‘প্রিভিলেজড জ়োন’ যেখানে আর কেউ ঢুকতে পারছেন না। লেখকের নিভৃত এই পরিসরে রয়েছে শুধুমাত্র স্বাধীনতা আর একাকিত্ব। এই মরুভূমি ক্রমাগত হয়ে উঠছে লেখকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তিনি রয়ে যাচ্ছেন এই অজান্তে তৈরি হয়ে ওঠা একাকিত্বের সাম্রাজ্যে। আর তিনি যা লিখছেন? প্রতিটি শব্দ, বাক্য, চিন্তা লেখা হয়ে যাওয়া মাত্রই তা হয়ে উঠছে অন্য কোনও সত্তার প্রকাশ, শব্দ হয়ে পড়ছে শূন্যগর্ভ। লেখক নিজের কল্পনাকে, নিজের চিন্তাকে বেঁধে উঠতে পারছেন না তাঁরই লেখা শব্দের ভিতর। ক্রমাগত তৈরি হয়ে চলেছে লেখার সঙ্গে লেখকের অনিবার্য দূরত্ব। ব্লাঁশো বলছেন, সাহিত্যকর্মের নির্যাসকে সময়ের গ্রাস থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় এই দূরত্ব। লেখার উপজীব্য লুকিয়ে রয়েছে তার অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে, লেখকের অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে। এই শূন্যতাই জন্ম দেয় ‘টাইমলেস মাস্টারপিস’-এর।
তার মানে কি লেখক কোনও সামাজিক জীব নন? তিনি কি প্রতি দিনের বাইরের এক জন মানুষ? নিশ্চয়ই তা নয়। এই প্রতি দিনের ভিতর থেকেই তিনি সংগ্রহ করছেন তাঁর চিন্তার রসদ, এখানেই ক্রমাগত বুনে চলেছেন তাঁর কল্পনার একান্ত জগৎ। তার পর কখন, অজান্তেই ঢুকে যাচ্ছেন তাঁর মরুভূমির ভিতর। এই যে মরুভূমির কথা ব্লাঁশো বলছেন, তা কিন্তু লেখকের স্বেচ্ছাকৃত নয়, এই পরিসর তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাঁর অজান্তেই। ভিতর-বাহিরের বোধ তাঁর ভিতর তৈরি হচ্ছে না, ভিড় করে আসা শব্দেরা আপনাআপনিই তৈরি করে দিচ্ছে এই বিচ্ছেদ।
মনে পড়ে কয়েক বছর আগের এক অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক জে এম কুটসিয়ার লেখা নিয়ে চলছে একটা আলোচনাসভা। সেখানে রয়েছেন বিশ্বের তাবড়-তাবড় কুটসিয়া বিশেষজ্ঞ। স্বয়ং লেখকও আমন্ত্রিত। তাঁর লেখা নিয়ে কথা বলছেন বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক ডেরেক এট্রিজ। বলছেন, তাঁর চিন্তার ব্যাপ্তির কথা, তাঁর দর্শনের গভীরতার কথা, উচ্চ প্রশংসা করছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের। হলঘরের এক কোনায় চুপচাপ, একা বসে রয়েছেন কুটসিয়া, জড়োসড়ো। সকলেই ফিরে তাকাচ্ছেন তাঁর দিকে, তিনি অপ্রতিভ, ক্রমাগত যেন আরও কুঁকড়ে যাচ্ছেন। খানিক পরে উঠে চলে গেলেন। বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও কিছুতেই কথা বলতে রাজি হলেন না। শেষে অবশ্য প্রিয় বন্ধু এট্রিজের অনুরোধে এলেন সকলের সামনে। মৃদু স্বরে বললেন, “আমি লিখি। বলতে অভ্যস্ত নই। এটুকুই বলবার যে আমার বলার মতো কিছু নেই।”
এখন আমাদের সারা দেশ জুড়ে লিট ফেস্ট-এর সমারোহ। থিকথিক করছেন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার। কলকাতা, দিল্লি, জয়পুর, শহরে শহরে খুলে যাচ্ছে সাহিত্য বিপণনের হাজারো দরজা। সাহিত্যিকেরা ছুটছেন এ শহর থেকে অন্য শহর। নিজেদের বই থেকে পাঠ করছেন, সই দিচ্ছেন, সাক্ষাৎকার চলছে ক্রমাগত। নিজের লেখা নিয়ে আলোচনা করে চলেছেন তাঁরা। কী ভাবে লিখলেন, কেন লিখলেন, এর পর কী লিখবেন। আর ক্রমাগত আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে সাহিত্যের উদ্দেশ্য। কেন লিখি? কেউ নারীবাদী বলে লেখেন, কেউ লেখেন পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত বলে, কেউ ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে, কেউ সমকাম নিয়ে আরও বেশি লেখা উচিত বলে। আন্দাজ করি, প্রকাশকের প্রতি তাঁদের কর্তব্যের তাগিদেই এই ক্রমাগত বলে চলা। শুধু লিখলে চলে না, বলে যেতে হবে ক্রমাগত—লিটফেস্টে, বইমেলায়, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমি লিখেছি, আমি পড়ব, বলব, সই দেব, সেলফি দেব। কোথায় সেই ব্লাঁশোর মরুভূমি, লেখকের নিভৃতচারণ, প্রতি মুহূর্তে নিজের অপারগতা লিখতে লিখতে চলা! শব্দের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে হেরে ফিরে আসা লেখকেরা আর বুঝি লেখেন না আজকাল! আজকালকার লেখকেরা বুঝি হেরে যেতে রাজি নন, যা লিখে উঠতে পারেননি সেই কষ্টেরই হয়তো সইশিকারি পাঠকের সঙ্গে সেলফির প্রশ্রয়ে খানিক উপশম করে নেন। মাঝেমধ্যে ভাবি, যদি জীবনানন্দ আজকে কবিতা লিখতেন, তিনিও কি বইমেলায় তাঁর কবিতার অন্তর্জগৎ নিয়ে আলোচনা করতেন? তাঁর মাথার ভিতরে কী ভাবে ‘বোধ’ কাজ করে, এই নিয়ে বলতেন? বিভূতিভূষণ কি বইমেলার অমুক স্টলে বিকেল তিনটে থেকে সই বিলোতেন?
যে লেখকের কথা ব্লাঁশো বলেছেন, আসলে তাঁরাও আছেন। নিরালায় শব্দের সঙ্গে নিরন্তর কারুণ্য ও ভিক্ষার সংলাপ তাঁদের ব্যস্ত রেখেছে। লিখে চলেছেন তাঁরা, অপারগ, নিষ্ফল তাগিদে। পাঠক কিন্তু তাঁর অপেক্ষাতেই রয়েছেন নিরন্তর। আচমকা সেই বই এসে পড়বে হাতে। খুলে যাবে বোধের দরজা।
লেখক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক