এই অবিশ্বাস, এই ধোঁয়াশা, এই সংশয়, কাম্য নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তথা শাসক দলকে সে কথা বুঝতে হবে। ফাইল চিত্র।
এই ঘন ধোঁয়াশা বাঞ্ছনীয় নয় মোটেই। দেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য উন্নত মানের ৩৬টি যুদ্ধবিমান আসবে, এ অত্যন্ত সুখবর। যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিকে ঘিরে ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে ধোঁয়াশা। আশঙ্কা হচ্ছে, রাফাল ফাইটার জেট এ ধোঁয়াশায় পথ না হারায়।
এত অস্বস্তি কিসের? রাফাল চুক্তি নিয়ে যখন বিরোধীরা এত প্রশ্ন তুলছেন, তখন জবাব দেওয়ায় এত অনীহা কিসের? সরকার বলছে, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই প্রতিরক্ষা চুক্তির সব শর্ত প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কী শর্তে বা কী দামে যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে, তা প্রকাশ করলে জাতীয় নিরাপত্তা কেন বিঘ্নিত হতে পারে, তা খুব সহজে বোধগম্য হয় না। তবু সরকার যখন বলছে, তখন সে কথায় আস্থা রাখা যাক। ধরে নেওয়া যাক, রাফাল চুক্তির সব শর্ত প্রকাশ্যে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সব শর্ত না বলা গেলেও, কিছু তো বলা যাবে। চুক্তির সামগ্রিক রূপরেখাটা কেমন, কী ভাবে একটি ভারতীয় এবং একটি ফরাসি সংস্থা পরস্পরকে বেছে নিল গাঁটছড়া বাঁধার জন্য— সে সব তো জানানো যেতেই পারে।
পূর্বতন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ইস্যুতেই সবচেয়ে তীক্ষ্ণ আক্রমণ শানাত বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদী ওই দুর্নীতি ইস্যুতে সুর চড়াতে শুরু করেছিলেন মনমোহন সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে। সুতরাং দুর্নীতির প্রশ্নে ঊর্ধ্বে থাকার দায় নরেন্দ্র মোদী সরকারের রয়েছে। রাফাল চুক্তি নিয়ে যখন বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ মোদীর বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে, তখন নীরব থাকা তাই মোদীকে মানায় না। জবাব দিতে তিনি দায়বদ্ধ।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ভারত সরকার জবাব দিক বা না দিক, ফ্রান্সের সরকার কিন্তু ঈষত্ মুখ খুলছে। যে ফরাসি প্রেসিডেন্টের আমলে রাফাল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ প্রথমে জানিয়েছিলেন, অনিল অম্বানীর সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ভারতের জন্য রাফাল তৈরি করা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না ফরাসি সংস্থা দাসোর সামনে। কারণ ভারত সরকারই অনিল অম্বানীর সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে বলেছিল, দাবি ছিল ওলাঁদের। প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য তুমুল হইচই ফেলল ভারতে। সরাসরি মোদীকে আক্রমণ করলেন রাহুল গাঁধী, ‘চোর’ বললেন। এর পরে ফের সক্রিয় হল ফরাসি সরকার। জানানো হল যে, ভারত সরকারের তরফ থেকে কোনও চাপ দেওয়া হয়নি। রাফাল নির্মাতা সংস্থা দাসো জানাল, অনিল অম্বানীর সংস্থার সঙ্গে স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তারা, কোনও চাপের মুখে নয়। এর পরে বক্তব্য কিছুটা সংশোধন করে নিলেন ওলাঁদও। তিনি ইঙ্গিত দিলেন তাঁর উপরে কোনও চাপ ছিল না। অনিল অম্বানীর সংস্থার সঙ্গে কেন গাঁটছড়া, সে প্রশ্নের উত্তর দাসো-ই ভাল দিতে পারবে বলেও ওলাঁদ ইঙ্গিত দিলেন। বিজেপি তত্ক্ষণাত্ পাল্টা আক্রমণে নামল দেশে। রাহুল গাঁধীকে নিজের মন্তব্য ফিরিয়ে নিতে বলল।
আরও পড়ুন: রাফাল-রিলায়্যান্স নিয়ে মুখ খুলল ফ্রান্স, তাতেও অস্বস্তি কাটল না মোদীর
আরও পড়ুন: ওলাঁদও চোর বললেন মোদীকে: রাহুল
বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর অস্বস্তি বেড়েছিল ওলাঁদের প্রথম দিনের মন্তব্যে। দ্বিতীয় দিনে কিছুটা সাবধানী মন্তব্য করলেন ওলাঁদ, তাতে বিজেপির সেই অস্বস্তি কিছুটা কেটে গেল। কিন্তু ধোঁয়াশা কাটল না, আরও বাড়ল বরং। ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট যা বলছেন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট যা বললেন, দাসো যা জানাল— সব কিছু মিলিয়েও কোনও একটা স্পষ্ট তত্ত্বে পৌঁছনো গেল না। আবার বলি, জাতীয় স্বার্থে যে সব কৌশলগত তথ্য গোপন রাখা দরকার তা গোপন রেখেও বাকি ধোঁয়াশাটা কাটানোর চেষ্টা করা উচিত ছিল। ফরাসি সরকারের এবং দাসো কর্তৃপক্ষের বক্তব্য মোদী সরকারের অস্বস্তি কিছুটা কাটিয়ে দিল হয়তো। কিন্তু যাঁর আমলে চুক্তি হয়েছিল, সেই ওলাঁদের দু’দিনের বয়ানে ফারাক থেকে গিয়েছে। অতএব অবিশ্বাসের বাতাবরণ আরও বেড়েছে বই কমেনি। এই অবিশ্বাস, এই ধোঁয়াশা, এই সংশয়, কাম্য নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তথা শাসক দলকে সে কথা বুঝতে হবে। এমন কিছু করতে হবে, যাতে এই অবিশ্বাসের জাল ছিন্ন হয়। তা না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু অ্যাডভান্টেজ রাহুল গাঁধীরাই।