শেষযাত্রায় কবিগুরু। ফাইল চিত্র
নানা রবীন্দ্রনাথের মালা বৈশাখে-শ্রাবণে আজ অন্তহীন। তবু তার মধ্যে হারিয়ে যায় ছোট ছোট স্মৃতি, টুকরো টুকরো গল্প। তেমনই একটি দুর্লভ শেষের স্মৃতি অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
সেই স্মৃতি থেকেই পড়া যায় আর এক রবীন্দ্রনাথকে, যিনি আসন্ন মৃত্যুকে দেখছেন। শেষ রোগশয্যায় দু’-এক জন কাছের মানুষের কাছে তিনি বললেন, ‘‘আমি এ বার বুঝতে পারছি, আমার এ পৃথিবীর দিন ফুরিয়ে এসেছে, এ বার যাবার সময় হয়েছে।’’ সেবাব্রতীরা বললেন, ‘‘কেন এ কথা বলছেন! আপনি ভাল হয়ে উঠবেন।’’ মৃদু হেসে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘না রে, বুঝতে পারছি আর দিন নেই।’’ তার পরে মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন, ‘‘আমি যেমন কোনও অশোভন কাজ পছন্দ করতাম না, তেমনই নিজেও কখনও করিনি। এ আমার মনের গোপন অভিমানের কথা। অভিমান-অহংকার বিন্দুমাত্র থাকলেও তো তাঁর নিকট যাওয়া যায় না—তাই তিনি নিজের কাছে নেওয়ার আগে আমার জ্ঞাত কি অজ্ঞাত সব অভিমান, সব অহংকার ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছেন। নিজের দেহকে আমি সর্বক্ষণ যথাসাধ্য আচ্ছাদিত করে রেখেছি। এমন-কি অসুখের ভিতরেও দেহের পরিচ্ছন্নতার তাগাদায় অন্যের স্পর্শে সর্বদেহ সংকুচিত হয়ে উঠেছে। দুদিন আগেও দেহটা আমার নিজের ভেবে অত্যন্ত সংকোচ বোধ করেছি—কিন্তু কাল থেকে সে কথা মোটেই মনে হচ্ছে না, কাজেই সংকোচবোধও দূর হয়ে গিয়েছে। এর থেকেই মনে হচ্ছে—দিন ফুরিয়ে এল।’’ এর পরের দিনই হয় রবীন্দ্রনাথের অপারেশন। তার অল্প দিন পরেই আসে সেই বাইশে শ্রাবণ।
অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই স্মৃতি রবীন্দ্রজীবনকে নতুন করে দেখার এক সন্ধান দেয়। সেই রবীন্দ্রনাথ ‘গুরুদেব’, ‘কবিগুরু’, ‘বিশ্বকবি’ ইত্যাদি বিশেষণের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষ রবীন্দ্রনাথ। মৈত্রেয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’, প্রতিমা দেবীর ‘নির্বাণ’ কিংবা নির্মলকুমারী মহলানবিশের ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর মতো বইয়ে সেই পরিচয় সুবিখ্যাত। কিন্তু এমন বিখ্যাত অতি-চর্চিত বইগুলির বাইরেও বেশ কিছু তুলনায় স্বল্প-পরিচিত, স্বল্প-আলোচিত বইপত্র ও লেখায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক ‘অপর’ ইতিহাস। সেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের আর একটি ছোটগল্প,—
‘সে কি রে তুই বীণা দিয়ে কী করবি, বীণা তো আমার এলাকায় পড়ে’, শিশুর মতো হেসে বলছেন রবীন্দ্রনাথ। বলছেন মুকুল দে-কে। মুকুল দে শান্তিনিকেতনের পুরনো ছাত্র, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। বীণা তাঁর স্ত্রী-র নাম। বিয়ের পরে তাঁকে নিয়ে মুকুল দে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করাতে। কিন্তু সেই প্রথম দেখা শান্তিনিকেতনে নয়, কলকাতায়। ১৯৩২ সালে কলকাতার নিপ্পন ক্লাবে এক জনসভায় জাপানের এক সুবিশাল ঘণ্টা উপহার দেওয়া হয় বৌদ্ধ সংস্কৃতি কেন্দ্র সারনাথে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সে সভায় প্রধান অতিথি। মুকুল দে তখন কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ। সস্ত্রীক গিয়েছেন সেই সভায়। নববধূর নাম শুনে তখনই রবীন্দ্রনাথের ওই মন্তব্য।
এ হেন বীণা অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন, তাঁর সেই রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের কথা। গুরুদেব কী-কী জিনিস খেতে ভালবাসেন, স্বামীর কাছে তার সন্ধান করছিলেন তিনি। জানলেন, তপসে মাছ, চন্দ্রপুলি ও আইসক্রিম তাঁর অতি প্রিয়। তখন এর অধিকাংশই ছিল শান্তিনিকেতন তথা বোলপুরে দুষ্প্রাপ্য। এমনকি, তখন সেখানে বরফ পাওয়া যেত না। কিন্তু এ সব রবীন্দ্রনাথকে খাওয়ানোর এত ইচ্ছে হয়েছিল বীণা দে-র যে কলকাতা থেকে আইসক্রিম-যন্ত্র, বরফ এবং তপসে মাছ সংগ্রহ করে, রান্না করে মুকুল দে-কে নিয়ে উত্তরায়ণে গেলেন রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াতে।
আর এই ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখতে গেলে দেখা যাবে শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে কোথায় যেন তার একটা যোগ থেকে গিয়েছে। যেমন, নন্দলাল বসুর স্ত্রী সুধীরাদেবীর স্মৃতিতেই যদি ডুব দেওয়া যায়, অসাধারণ সব ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাবে। অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মহিলাদের স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বইয়ে বিবরণ দিয়েছেন সেই সব ঘটনার। তাঁরই অনুসরণে দেখা যাক ঘটনাগুলিকে। শান্তিনিকেতনে দেহলির বিপরীতে ছিল একটি দোতলা পাকা বাড়ি, নাম ছিল ‘দ্বারিক’। রবীন্দ্রনাথের কাছে থাকার জন্য উইলিয়াম স্ট্যানলি পিয়ার্সন দেহলির পাশেই এই সুন্দর দোতলা বাড়িটি নিজের অর্থে নির্মাণ করান। পরে তিনি বাড়িটি আশ্রমকে দান করে যান। এই বাড়িটিরই ওপরের তলায় কলাভবন ও নীচের তলায় সঙ্গীতভবনের প্রথম পত্তন হয়।
সময়ের ব্যবধানে কলাভবন ও সঙ্গীতভবন স্থানান্তরিত হয়ে যায়, ‘দ্বারিক’ পরিণত হয় ছাত্রী আবাসে। মেয়েরা তখন ছাত্রী-আবাসে হেমবালা সেনের অধীনে থাকতেন। এমনই এক দিনে প্রতিমাদেবী, সুধীরাদেবী প্রমুখের মাথায় চাপল এক খেয়াল। গ্রীষ্মের এক রাতে মেয়েরা যখন ঘুমোচ্ছেন দ্বারিকে, ঘুমোচ্ছেন তাদের অধিনায়িকা হেমবালা দেবীও, হঠাৎ ‘ডাকাত’ পড়ল। কালি-ঝুলি মাখা, পাগড়ি পরা, লম্বা লাঠি হাতে ডাকাতের দল মেয়েদের অলঙ্কার নিয়ে টানাটানি আরম্ভ করল। শোরগোল পড়ে গেল। তারই মধ্যে দু-চার জন মেয়ে ছিলেন অতি-সহসী। তেমন এক জনের গলার হারে হাত দেওয়া মাত্র তিনি ডাকাতের হাত চেপে ধরেন সজোরে। অনেক কষ্টে ডাকাত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উধাও।
এ দিকে, মেয়েদের চিৎকারে ছুটে এসেছেন আশপাশের সবাই। কিন্তু কী আশ্চর্য, শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র মজুমদার সবাইকে অভয় দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘‘কিছু না কিছু না, কিচ্ছু হয়নি।’’ মেয়েরা তো রেগেই আগুন, হেমবালাদেবী বলতে লাগলেন, ‘‘এতগুলো মেয়ে নিয়ে খোলা মাঠে এমন অরক্ষিত ভাবে থাকতে আমার আর সাহস হয় না, উপযুক্ত রক্ষকের ব্যবস্থা চাই।’’ শেষমেষ কিছুতেই তাদের বোঝাতে না পেরে সন্তোষচন্দ্র কালি-মাখা কমলাদেবীকে এনে দেখালেন, সবই নকল ডাকাত। এর কিছু দিন পরে ভুবনডাঙায় জগদানন্দ রায়ের বাড়িতে আসল ডাকাত পড়ে। পরদিন রবীন্দ্রনাথ প্রতিমাদেবীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘বৌমা, তোমাদের দল নয় তো!’’
রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই যেতেন ‘প্রবাসী’র সম্পাদক বাঁকুড়ার বিশিষ্ট সন্তান রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তিনি এলে সে বাড়িতে বসত সাহিত্য ও সঙ্গীত-সভা। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দুই কন্যা শান্তাদেবী ও সীতাদেবী। সভায় সীতাদেবীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, ‘আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে’। তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল নিজে গান গাওয়ার সময় আশপাশের গায়ক-গায়িকাদের নিজের সঙ্গে গাইতে বলতেন ও গানটি শিখে নিতে বলতেন। কিন্তু ওই গানটি সে দিন গাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে কেউ গাইলেন না। গান শেষ করে রবীন্দ্রনাথ শান্তা-সীতাকে বললেন, ‘‘তোরা চুপ করে রইলি কেন, আমার সঙ্গে গাইতে পারলি না!’’ সীতা দেবী বললেন, ‘‘কী করে গাইব, আপনি যে সম্পূর্ণ নতুন সুরে গাইলেন—এ সুর আমাদের জানা নেই।’’ রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘‘তোরা কী সুর শিখেছিস শোনা দেখি।’’ শোনালেন সীতা। তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘তা হবে, আমারই হয়তো ভুল হয়েছে।’’
রবীন্দ্রনাথের গানের শুদ্ধতা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাঝে ঘটনাটি মনে রাখার মতো এই জন্য যে ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শুদ্ধতা রক্ষার তাগিদে আমরা যেন স্রষ্টার পরিবর্তনশীলতাকে অস্বীকার না করি।
সেই নিরন্তর বদলে চলার ধর্মেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চিরনতুন, জীবনের শেষ বাইশে শ্রাবণ পর্যন্ত।
লেখক উপ-পরিচালক, গ্রন্থন বিভাগ, বিশ্বভারতী