গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্ত উৎসবে সম্প্রতি যা ঘটেছে, তা নিন্দনীয়— এই বাক্যটি এই মুহূর্তে ক্লিশে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অতিব্যবহারে ইতিমধ্যেই জীর্ণ হয়ে পড়েছে। এক শিক্ষায়তনের নিজস্ব উৎসবে বাইরে থেকে প্রবেশ করে কিছু লোকের অশালীনতা প্রদর্শনকে কেবল ‘নিন্দনীয়’ বলে থেমে থাকা যায় না। তারও অতিরিক্ত কিছু বলতে ইচ্ছে করে।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় রবীন্দ্রভারতীর বসন্ত উৎসবের কিছু ছবি। তাতে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের এক বিখ্যাত গানের পঙক্তিকে বিকৃত করে তা আবির দিয়ে পিঠে লিখে কিছু তরুণী ছবি তুলেছেন। তার খানিক পরেই দেখা যায়, আরও কিছু তরুণী পিঠে বেশ কিছু অশালীন শব্দ লিখে ছবি তুলিয়েছেন এবং কিছু তরুণও সেই খেলায় সামিল। ফেসবুকে এই ছবিগুলি পোস্ট হতে শুরু করলে মুহূর্তে ভাইরাল হয় এবং বিষয়টি নিয়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।
নিন্দার অভিমুখ ছিল অনেকগুলি। যার মধ্যে রবীন্দ্র-বিকৃতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবমাননা, তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধগত অবক্ষয় ছিল প্রধান। এই সব নিন্দামূলক পোস্টের তলায় ‘বেশ করেছে’-সুলভ কমেন্টও কম পড়েনি। ফলে একটা বিতর্কের আবহাওয়া ঘনিয়ে ওঠে। জল অনেক দূর গড়ায়। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘটনার প্রেক্ষিতে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেন রাজ্যপালের কাছে।
আরও পড়ুন: ওরা ভুল করেছে, কিন্তু কোনও অপরাধ করেনি
নেটাগরিকদের একাংশ এই ‘সামান্য ঘটনা’ এত দূর গড়িয়ে যাওয়া নিয়ে সরব হয়েছেন। উপাচার্যের ইস্তফার যৌক্তিকতা নিয়ে আবার তর্কে মেতেছেন। নেটাগরিকদের আর একটি বড় অংশ এখনও রবীন্দ্র-অবমাননা, সাংস্কৃতিক দূষণ ও নব্য প্রজন্মের অধঃপতন নিয়ে তরজারত। প্রসঙ্গত, এই ঘটনার শিকড় খানিক গভীরে। কয়েক মাস আগে রোদ্দুর রায় নামধারী জনৈক ইউটিউবার ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানটির একটি বিকৃত রূপ গেয়ে একটি ভিডিয়ো আপলোড করেন। তা থেকেই ছড়াতে থাকে ওই বিকৃত রূপটি। কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেই বিকৃত রূপটি ছাত্র-ছাত্রীরা গাইছে— এমন ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসে। এক প্রস্থ নিন্দেমন্দ তখন হয়। তার পরে বিষয়টি স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু তাকে আবার তরজার আসরে নামায় রবীন্দ্রভারতীর ঘটনা।
যিনি এই ঘটনার উৎস, সেই রোদ্দুর রায় এক পুরনো ইউটিউবার। বিকৃত সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে এবং কিছু খিস্তি-সম্বলিত কবিতা পাঠ করে তিনি কিঞ্চিৎ পরিচিত মুখ অনেকদিনই। তাঁকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঈষৎ গালমন্দ ও পিঠ-চাপড়ানি— দুই-ই চলে। এক কথায়, তাঁর অঢেল নিন্দুক ও বিস্তর অনুগামী বিদ্যমান। ব্যাপারটা ঐ পর্যন্তই আটকে ছিল। ইউটিউবে রোদ্দুর রায়ের গানের নীচে তীব্র গালাগাল দিয়ে অনেকেই রাগ মেটাতেন। রোদ্দুর তার পরে আবার একটা বিকৃত গান আপলোড করতেন। এর বেশি কিছু ঘটত না। কিন্তু কোনও এক দুর্জ্ঞেয় কারণে ‘সেদিন দুজনে’-র বিকৃতি রোদ্দুর রায়কে পুনর্নবীকৃত করে। তিনি রিভাইটালাইজড হয়ে এ বার সোশ্যাল মিডিয়া দাপাতে শুরু করেন। এবং এতকাল নিজেকে ভার্চুয়াল পরিসরে আটকে রাখার পরে নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। এক গ্রন্থপ্রকাশ ও ছবির একজিবিশন সূত্রে তিনি জনসমক্ষে আবির্ভূত হন। তাঁর সমর্থককুল তাঁকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মূর্তরূপ ও অল্টারনেটিভ সংস্কৃতির অগ্রদূত বলে প্রচার করেন। কিন্তু রোদ্দুরবাবুর কেরদানি ওই ‘সেদিন দুজনে’-র বিকৃতিতেই আটকে থাকে, তাঁর রচিত বই ও তাঁর অঙ্কিত ছবি নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে তেমন কারোকে দেখা যায়নি।
রোদ্দুর রায়ের ইউএসপি মূলত রবীন্দ্র-বিকৃতি। যাঁরা তাতে আমোদের উপকরণ খুঁজে পান, তাঁদের মতে রোদ্দুর ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক এক অচলায়তনকে ভাঙছেন। রবীন্দ্র-ন্যাকামির উপরে তীব্র কশাঘাত হানছেন। তাঁর এই কর্ম এক সুবিশাল সাবভার্শন। বগলে কালাশনিকভ নিয়ে রোদ্দুর বাংলা সংস্কৃতি আর তার নীতিপুলিশদের দেখে নিচ্ছেন। এই কালাশনিকভটি আদতে কাঁচা খিস্তি। প্রয়াত লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর বিখ্যাত ফ্যাতাড়ু সিরিজে যে অন্তর্ঘাতকে তুলে ধরেছিলেন, রোদ্দুরবাবুর কর্মকাণ্ড তারই উত্তরাধিকার—এই মর্মে তিনি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারও প্রদান করেন। কিন্তু নবারুণের ফ্যাতাড়ু সিরিজের উইট ও হিউমার যে তাঁর নেই, এ কথা উহ্য থেকে যায়। সে যাই হোক, ‘সেদিন দুজনে’-বিকার ক্রমে ভাইরাল হয়। খোদ বিশ্বভারতীতেও মাইক বাজিয়ে সেই বিকৃতি গেয়ে নাচানাচির ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসে।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রভারতীতে উপাচার্যের ইস্তফা, আগামী বছর বসন্ত উৎসব নিয়ে সংশয়
রবিন্দ্রভারতীর সাম্প্রতিক ঘটনা এই সবেরই এক্সটেনশন। রোদ্দুর রায়-প্রদর্শিত ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ বা ‘কাউন্টার কালচার’-এর বহমানতা। রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে তাঁরই পরিকল্পিত বসন্ত উৎসবের মাঝখানে একটা ঘোরতর সাবভার্শন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? যাঁরা এদিন পিঠে ওই সব লিখে ছবি তোলালেন, তাঁরা কোন অচলায়তনকে ভাঙতে চেয়েছিলেন? খবর, যাঁরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, তাঁরা কেউই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। তা হলে কি রবীন্দ্রভারতী নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই ‘জেহাদ’? কিন্তু আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রভারতী রবীন্দ্র-সংস্কৃতি নিয়ে কোনও নীতিপুলিশি করেছে বলে জানা নেই। তা হলে? না। ব্যাপারটার পিছনে সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাতের সুতো খুঁজতে গেলে বিড়ম্বনা বাড়বে বই কমবে না। সম্ভবত, এ সব কিছুই ঘটাতে চাননি তাঁরা। কোনও একটা অছিলায় নিজেদের ‘ভাইরাল’ করে তোলা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য এর পিছনে ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত যে ছবিটি পোস্টে পোস্টে ঘুরেছে, সেটি পরিকল্পিত ভাবেই তোলা— এটা স্পষ্ট। রোদ্দুর-কালচারের (বা ‘কাউন্টার কালচারের’) সঙ্গে এর কোনও লেনা-দেনা নেই বলেই মনে হয়। এ কাণ্ড নেহাত ‘আমাকে দেখুন’ প্রজন্মের ঘোরতর নার্সিসিজম থেকেই জাত, তার বেশি কিছু নয়।
আরও পড়ুন: বসন্ত উৎসবের ধাক্কা! ইস্তফা দিলেন রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য
অনেক নেটাগরিক এ কথা বলছেন যে, মেয়েদের শরীরে অশালীন শব্দের ছবিই আপত্তির মূলে। মনে রাখা দরকার, সে দিন বসন্ত উৎসবে বেশ কিছু যুবকও বুকে অশালীন শব্দ লিখে ছবি তুলে আপলোড করেছিলেন। এখানে লিঙ্গভেদ খোঁজার কোনও মানে হয় না। তবে আমাদের মধ্যবিত্ত চোখে মেয়েদের যে আর্কিটাইপটি ঘাপটি মেরে রয়েছে, তাতে ওই ছবি খানিক ঘা দিয়েছে, সন্দেহ নেই। এখানে যদি নীতিপুলিশির অভিযোগ তোলা যায়, তা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু পুলিশি করার আগে এটা কি জেনে রাখা জরুরি নয় যে, অনাবদ্ধ বিশ্বে এই মুহূর্তে জেন্ডার-স্পেসিফিক পরিসরগুলি উদ্বায়িত হয়েছে। বহুদিন ধরেই ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন পোস্টে মেয়েরা সাবলীল ভাবে তথাকথিক অশালীন ভাষাকে অবলম্বন করে বহু বিচিত্র জিনিস লিখে চলেছেন। এটাকে ‘সমাজের সামূহিক বিকৃতি’ বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ‘মি টু’ আন্দোলনে যখন মেয়েরা মুখ খুলছেন, তখন কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে আর কোন ভাষা হবে না, এই শাসন অবান্তর। সেই সূত্র ধরে যদি নিজেদের পিঠে কিছু অশালীন শব্দ লিখে কেউ ফায়দা লুঠতে চান, তা হলে কিছু করার থাকে না। ১৯৮০-র দশকে বাজারে ‘সত্য কাহিনি’, ‘অপরাধ-তদন্ত’-মার্কা কিছু পত্রিকার আবির্ভাব ঘটেছিল। অপরাধের বর্ণনা দিতে গিয়ে সেই সব পত্রিকায় প্রকাশিত হতো নরম পর্নোগ্রাফি। খুব বেশি দিন সেই হিড়িক স্থায়ী হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই সেই সব পত্রিকার এন্তেকাল ঘটে। এই উদাহরণ থেকে বলা যেতেই পারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই হিড়িকও খুব বেশিদিন টিকবে না। ব্যবহৃত হতে হতে এই সব কাণ্ড তাদের ‘মহিমা’ হারাবে। পাবলিক আর এসব খাবে না।
আরও পড়ুন: টিএমসিপি থেকে পরিবার, বসন্ত উৎসব কাণ্ডে আঙুল উঠছে সব দিকে
এই খিস্তি-কালচারের সঙ্গে সাবভার্সনকে একাকার করে দেখাটা আরও বড় বিকৃতি। ১৯৯০-এর দশকে যখন অনেক কিছুর মতো সমাজ পালটানো বা বিপ্লবের ধারণা বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে, তখন ফ্যাতাড়ু গোষ্ঠীর ‘পারলেই ড্যামেজ করো’— এক নতুন দিশা নিয়ে আসে। ফ্যাতাড়ুরা খিস্তি করেছিল, কিন্তু অস্থানে নয়। অন্যায্য কারোর পিছনে নয়। বসন্ত উৎসবের ঘটনার সূত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসছে ‘রবীন্দ্র মৌলবাদ’ শব্দবন্ধটি। এই মুহূর্তে সেটা কী বস্তু— এই প্রশ্ন সংগত ভাবে জাগে। যে মৌলবাদের হ্যাপা পুইয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, রবীন্দ্র-বিরোধিতা করে যে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে (‘তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র রচনাবলী গড়ায় পাপোষে’ লেখার প্রেক্ষিতে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় কেতকী কুশারীর জ্বলন্ত পত্র-প্রতিবাদ কে ভুলতে পারে?), তার সঙ্গে এই খিস্তোগ্রাফির কী সত্যিই কোনও তুলনা চলে? রবীন্দ্র মৌলবাদ কি আজও টিকে রয়েছে? এই মুহূর্তে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডেডিকেটেড শ্রোতা ক’জন? রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক্সক্লুসিভ অনুষ্ঠানগুলিতে অডিয়েন্সের অপ্রতুলতার কথা নতুন করে বলার আছে কি? গবেষক ছাড়া রবীন্দ্র-সাহিত্যের পাঠকই বা কোথায়? এই সব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে বসলে রোদ্দুর আর তাঁর অনুগামীদের কর্মকাণ্ডকে হাস্যকরের অতিরিক্ত কিছু বলে মনে হবে না। কপিরাইটহীন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যা খুশি করা যায়। যেমন খুশি সুরে তাঁর গান গাওয়া যায়। এমনকি, তা যদি দেশের জাতীয় সঙ্গীতও হয়ে থাকে, তবে মারমুখী দাঙ্গাবাজদের লাঠির আঘাতে প্রাণবায়ু ওষ্ঠে নিয়েও গাওয়া যায় (গাইতে হয়) রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেখানে কিছু মানুষের দেহে বিকৃত রবীন্দ্র-পঙক্তি আর কী এমন ‘বিপ্লব’?
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রভারতীর দোল-কাণ্ডে চিহ্নিত ৫ পড়ুয়া, থানায় অভিযোগ, নিন্দা রাজ্য জুড়ে
পুরোটাই ছায়ার সঙ্গে কুস্তি। প্রতিপক্ষ কে, আমরা জানি না। কিন্তু দ্রোহ একটা করে যেতে হবে। পুরো একটা জাতের মাথায় যখন রাষ্ট্রিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক কালো মেঘ ঘনিয়ে রয়েছে তখন, এই খুচরো অশান্তি করে সাবভার্ট করা হচ্ছে অনেক সিরিয়াস ইস্যুকেই। অবশ্য এই বোধও গাত্রে খিস্তি লিখে ছবি তুলিয়েদের ছিল বলে মনে হয় না। তাঁরা ‘মজা’ করতে চেয়েছিলেন। ঋত্বিক-উবাচে ‘বীভৎস মজা’। আর সেটাই বুমেরাং হয়েছে। ঘটনা যে উপাচার্যের পদত্যাগ পর্যন্ত গড়াবে, সেটা দেহ-গ্রাফিত্তির রচয়িতাদের মাথায় ছিল না। তাঁরা হুজুকের ন্যাড়া। হুজুক মিটলে ঝাঁকের কই। কিন্তু হুজুকের ঠেলা যে কত জনকে কত ভাবে বইতে হতে পারে, তা তাঁদের বোধের বাইরে।