পঞ্চসায়র এলাকার সেই বৃদ্ধাবাস।
নাম নথিভুক্ত করা নাই। অথচ ব্যবসা চলিতেছে। প্রবীণদের লইয়া ব্যবসা। বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ মানুষদের আশ্রয়স্থল হিসাবে ইদানীং শহরের যত্রতত্র গড়িয়া উঠিতেছে বৃদ্ধাশ্রম। অথচ, এই ব্যবসায় ন্যূনতম কোনও সরকারি নিয়ম মানা হয় কি না, দেখিবার ব্যবস্থা নাই। বৃদ্ধাশ্রমগুলির এ-হেন শোচনীয় অবস্থার ছবিটি হয়তো আজও স্পষ্ট হইত না, যদি না পঞ্চসায়রের একটি হোমের এক আবাসিক গণধর্ষণের শিকার হইতেন। তদন্তে প্রকাশ, গভীর রাত্রিতে তালা ভাঙিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন এই আবাসিক বাহির হইয়া গিয়াছিলেন। অথচ বৃদ্ধাবাসের কোনও কর্মীর তাহা নজরে আসে নাই। এমনকি বৃদ্ধাবাসটিতে ওই রাত্রিতে আবাসিকের সংখ্যা কত ছিল, তাহাও জানা যায় নাই। কারণ আবাসিকদের হিসাবখাতা রাখিবার ‘নিয়ম’ সেখানে নাই। কোনও প্রকার বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই এত দিন তাহা দিব্য চলিতেছিল।
প্রশাসন তবে কী করিতেছিল? উত্তর হইল, বৃদ্ধাবাস নথিভুক্তকরণ সংক্রান্ত কোনও স্পষ্ট সরকারি নিয়ম নাই, সুতরাং সরকারের আপাতদৃষ্টিতে কোনও দায়ও নাই। অস্পষ্টতার সেই ফাঁক গলিয়াই অবাধে বেনিয়ম প্রবেশ করিয়াছে ক্ষেত্রটিতে। পরিস্থিতি এমনই যে, যে কেহ একটি বাড়ি লইয়া সেখানে বৃদ্ধাবাস খুলিতে পারেন। কিন্তু আশ্রয় লওয়া মানুষগুলিকে সেবার জন্য যে ন্যূনতম পরিকাঠামো দরকার, তাহা সর্বত্র মানা হয় না। পঞ্চসায়রের ঘটনাটিতেই ইহা স্পষ্ট। নিরাপত্তার আশায় প্রবীণ মানুষগুলি নিজ সংসার ছাড়িয়া বৃদ্ধাশ্রমকে আঁকড়াইয়া ধরেন। অথচ সেই নিরাপত্তাতেই বিপুল ফাঁক। এত জন বয়স্ক মানুষের দায়িত্ব লইতে হইলে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মী, সর্ব ক্ষণের চিকিৎসক, আপৎকালীন চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হয়। সেই ব্যবস্থাপনা হঠাৎ-গজাইয়া উঠা বৃদ্ধাবাসে অসম্ভব। অভিযোগ থাকিলেও অশক্ত আবাসিকদের পক্ষে সংগঠিত ভাবে সেই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করাও সম্ভব নহে। সমস্যা অন্যত্রও। বৃদ্ধাবাস স্থাপনের সঙ্গে ‘সেবা’র ধারণাটি ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। অনাত্মীয় প্রবীণদের অন্তিম দিনগুলিতে দেখাশুনার কাজটি মহৎ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু সময়বিশেষে সেই মহত্ত্বের ধারণার আলোকচ্ছটা এতই তীব্র হইয়া উঠে যে, তাহা অন্ধকারটুকু সযত্নে ঢাকিয়া দেয়। বড় অনিয়ম না ঘটিলে অ-ব্যবস্থাগুলি চোখে পড়ে না।
অ-ব্যবস্থা রোধ করিতে হইলে অবিলম্বে সমস্ত বৃদ্ধাবাসের নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। নথিভুক্ত করিবার অর্থ ইহা নয় যে, বৃদ্ধাবাসগুলির যাবতীয় দায়িত্ব সরকারের স্কন্ধেই অর্পিত হইল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি খুঁটিনাটির দায়িত্ব সরকার লইতে পারে না। লওয়া অনুচিতও। তাহা বলিয়া সরকারের কোনও দায়িত্ব নাই, তাহাও নহে। সরকারের কাজ অন্যবিধ। সরকার সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রস্তুত করিতে পারে, নিয়ম লঙ্ঘিত হইলে সংশ্লিষ্ট বৃদ্ধাবাসটির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা করিতে পারে, প্রয়োজনে কিছু অর্থসাহায্যও করিতে পারে। নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক হইলে বৃদ্ধাশ্রমগুলির দায়িত্ব থাকিবে স্ব-অস্তিত্ব বজায় রাখিতে সরকারি নির্দেশিকা মানিয়া চলিবার। অ-নিয়ম রুখিতে সরকার স্বয়ং নজরদারি চালাইতে পারে, অথবা অ-সরকারি সংস্থাগুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করিতে পারে। ইহাতে বৃদ্ধাশ্রমের নিরাপত্তা বাড়িবে, স্বস্তি পাইবেন প্রবীণরাও।