গণতন্ত্র মানে কী? সুস্থ গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতার গুরুত্ব কতখানি? বিরোধী পক্ষ ছাড়া গণতন্ত্র কতটা অর্থবহ? নিয়মিত এ সব প্রশ্নে চর্চা হয়। বহু জ্ঞানী, গুণী, চিন্তাশীল ব্যক্তি এ সম্পর্কে সুযোগ পেলেই মতামত ব্যক্ত করে থাকেন। উত্তরও সম্ভবত সকলেরই মোটামুটি জানা হয়ে গিয়েছে। সোজা কথায় আমরা বুঝি, গণতন্ত্র মানে মত প্রকাশের অবাধ অধিকার। গণতন্ত্র মানে চাপমুক্ত বিরোধী পরিসর। গণতন্ত্র মানে মুক্ত হাওয়া। তাই ভোটকে বলা হয় গণতন্ত্রের উৎসব। যেখানে জনতার রায়ের ভিত্তিতে শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষের অবস্থানই মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃত।
এখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের মরসুমে গণতন্ত্র আরও এক বার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ, মনোনয়নপর্ব থেকেই এ বার সন্ত্রাসের অভিযোগে সরব বিরোধী দলগুলি। একই অভিযোগে বিরোধীদের বিঁধছে শাসকরাও। মারামারি, খুনজখমের বহু ঘটনা ঘটেছে, সেটাও ঠিক। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ঘটনার দায় নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের সংঘাত তুঙ্গে। পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মোট আসনের ৩৪ শতাংশ ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে শাসক দল। গ্রাম পঞ্চায়েতে ২০ হাজারের বেশি আসনে বিরোধী প্রার্থী ছিলেন না। যেটা অভূতপূর্ব।
এমনই এক পরিস্থিতিতে অন্য রকম একটি ভাবনা উস্কে দিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। দিন কয়েক আগে আনন্দ পুরস্কার প্রদানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি জানতে চেয়েছেন, আদিবাসী সমাজে যে ভাবে গণতন্ত্রের অনুশীলন হয়ে এসেছে, সেখান থেকে আমরা শিখতে পারলাম না কেন?
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণববাবু দেশের অন্যতম কৃতী রাজনীতিক। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে গণতন্ত্রের নানাবিধ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। সামলাতে হয়েছে বহু কঠিন সংসদীয় সমস্যা। সাম্প্রতিক পটভূমিকায় তাঁর আপাতনির্বিষ ওই পর্যবেক্ষণ তাই হয়তো কোনও অর্থ বহন করে!
তিনি যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে পঞ্চায়েতের কাজে গ্রামের সকলের অংশগ্রহণের দরজা খোলা। কোনও বিষয়ে সবাই যত ক্ষণ একমত না হচ্ছেন, তত ক্ষণ আলোচনা চলত। মতদানের অধিকার পেতেন সবাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ, সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে কোনও ভেদবিচার ছিল না। পঞ্চায়েত আইনে কিন্তু এখনও অনেকটা এই রকমই এক ‘গণতন্ত্র’-এর সংস্থান আছে। তা হল, পঞ্চায়েত এলাকায় কোথায় কী কাজ হবে, তা ঠিক করতে গ্রাম সংসদের সভা করতে হবে এবং সেই সংসদে সদস্য থাকবেন গ্রাম পঞ্চায়েতের পরাজিত প্রার্থী। লক্ষ্য পরিষ্কার। কোথাও কোনও পক্ষপাতিত্ব বা ক্ষমতা ফলানোর পরিস্থিতি যেন না থাকে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে, আমরা জানি, ৫১ সর্বদাই ৪৯-এর মতকে দাবিয়ে রাখার অধিকার পেয়ে যায়। এটা একপ্রকার স্বীকৃত। ৫১ যেই মসনদে বসে, ৪৯-কে তখন সে আর পাত্তা দিতে চায় না। সংখ্যা দু’টি অবশ্য এ ক্ষেত্রে উদাহরণমাত্র। আসল কথা হল, যে দল বা ফ্রন্ট সর্বাধিক আসন পায়, সে-ই হুকুমদার হয়।
তা বলে আসনসংখ্যা বেশি হলেই কি সেই দল বেশি মানুষের সমর্থনপুষ্ট বলে ধরে নিতে হবে? সংসদীয় গণতন্ত্রে এক অদ্ভুত ধাঁধা এখানেও। প্রণববাবু মনে করিয়ে দিয়েছেন, আজ পর্যন্ত ভারতে কোনও শাসক দলই ৫১% ভোট পায়নি। বিরোধীদের সম্মিলিত ভোট শতাংশ সর্বদাই শাসক পক্ষের চেয়ে বেশি থেকেছে। অর্থাৎ, শুধু আসনসংখ্যার হিসেবে, সংখ্যালঘু মানুষের সমর্থনের ভিত্তিতেই ভারতে তৈরি হয়েছে একের পর এক সরকার— জওহরলাল নেহরু থেকে নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত। আমাদের রাজ্যের দিকে তাকালেও সেই ধারারই প্রতিফলন স্পষ্ট হয়।
বিরোধীদের দাবিয়ে রাখার প্রবণতাতেও এই রাজ্য বেশ পোক্ত। সিদ্ধার্থ রায়ের কংগ্রেস রাজত্ব, জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের বাম জমানা এবং এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল আমল—ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। গণতন্ত্রে বিরোধীদের যে কোনও ভূমিকা থাকতে পারে, সেটা মেনে নেওয়ার প্রশ্নেই যেন যত সমস্যা। হয় তুমি আমার লোক, নয় তুমি শত্রু— সকলেরই ভাবখানা এই রকম। এর মধ্যে সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতার মতো ভাবনাচিন্তার স্থান কোথায়! সে পাট বহু দিন আগেই চুকেছে। ইতিহাস সাক্ষী।
শাসকের আসনে বসলেই কেন এমন রুদ্ধ মানসিকতা তৈরি হয়, তারও অনেক রকম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। যেমন, ক্ষমতা ভোগের সর্বগ্রাসী তাড়না, ক্ষমতা হারানোর ভয়, সমালোচনা বরদাস্ত না করা, পূর্ণ রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করে অনুগতবাহিনী তৈরি করা ইত্যাদি। অনেকের মতে আবার এটা অনেকটা ‘বঞ্চিতের বদলা নেওয়া’র মতো ব্যাপার। কাল বিরোধী হিসাবে যাঁরা ‘দমন’-এর শিকার হয়েছেন, আজ শাসক হয়ে তাঁরা সুদে-আসলে সেটা ফিরিয়ে দিতে চান। ফলে চক্রাকারে এটা চলতেই থাকে।
তবে এ সবের মধ্যে না গিয়েও একটা কথা সত্যি। শীর্ষ স্তরে এমন ঔদ্ধত্যের প্রবণতা যে কোনও দলেরই নিচু তলায় গভীর প্রভাব ফেলে। যার অনিবার্য পরিণাম হল রাজনৈতিক হিংস্রতা। যা এক সময় উপর তলার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শাসক, বিরোধী সবাই এর শরিক। আরও স্পষ্ট বললে, এটা দলমতনির্বিশেষে রাজনীতিকদের স্বখাতসলিলে ডুবে মরার মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপ। অথচ এ থেকে মুক্ত হতে কেউ পারেন না।
এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে যা চলছে, সেখানেও বিতর্কের অন্ত নেই। বিরোধীদের মনোনয়ন দিতে না-পারা থেকে শুরু করে খুন-জখম-রক্তপাত— অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। এর কতটা বাস্তব, কতটা ‘তৈরি’ করা, সেই তর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু এটুকু বলা চলে, গণতন্ত্র আরও এক বার পরীক্ষার মুখে।
তা হলে আরও এক বার ইতিহাসের পাতা ওল্টাতেও তো দোষ নেই। আজ শাসক তৃণমূল বলছে, বিরোধীদের লোক কোথায়, যে ওরা প্রার্থী দেবে! অতীতেও পঞ্চায়েতে প্রার্থী দিতে না পেরে কংগ্রেস যখন অভিযোগ করত, জ্যোতি বসু-অনিল বিশ্বাসেরা একই সুরে বলতেন, আমরা কি ওদের প্রার্থী করার জন্য লোক সাপ্লাই দেব? ১৯৭২-এর নির্বাচনে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক সন্ত্রাস ও রিগিংয়ের অভিযোগ তুলেছিল বামেরা। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসেই বামফ্রন্ট এ নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন বসায়। যত দূর জানি, রিপোর্টে ৪০/৫০টির বেশি বিধানসভা কেন্দ্রে রিগিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কংগ্রেস নেতারা বলতেন, ওই ৫০টি বাদ দিলেও কিন্তু আমাদের ‘জয়’ আটকাত না।
গণতন্ত্রের ‘মহিমা’ এ ভাবেই যুগে যুগে, কালে কালে অক্ষুণ্ণ থেকে যায়। শ্রদ্ধেয় প্রণবদার নির্বিষ খোঁচা কি সেই উপলব্ধিটাই ফের জাগিয়ে দিল?