সতেরোতম লোকসভার সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটি কার্যত স্লোগান দিবার প্রতিযোগিতায় চাপা পড়িল। কেহ বলিলেন ‘জয় শ্রীরাম’, কেহ ‘আল্লাহু আকবর’, কেহ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। স্বাভাবিক সৌজন্যের পরিবর্তে অস্বাভাবিক দ্বন্দ্বের আবহে সম্পন্ন হইল আইনসভার প্রতি দায়বদ্ধতা পালনের প্রতিশ্রুতি গ্রহণের আয়োজনটি। হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসিকে ‘ভারত মাতা কি জয়’, ‘বন্দে মাতরম্’ প্রভৃতি স্লোগানে স্বাগত জানাইলেন ট্রেজ়ারি বেঞ্চের কয়েক জন সাংসদ। কংগ্রেসের সনিয়া গাঁধী ও তৃণমূল সাংসদদের ক্ষেত্রেও ইহার পুনরাবৃত্তি ঘটিল। পশ্চিমবঙ্গের সাংসদরা ‘জয় হিন্দ’, ‘জয় বাংলা’ পাল্টা ধ্বনি তুলিলেন। সংসদে নজির ভাঙিবার এবং গড়িবার এই তালিকা চলিতে থাকিল। এই আচরণ অসংযত, তাহা সাংসদেরা পরে বুঝিয়াছেন কি না জানা নাই, তবে তাঁহারা যাঁহাদের প্রতিনিধি, সেই ভারতীয় জনতা গভীর লজ্জা বোধ করিয়াছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়াছে। স্পিকার ওম বিড়লা নির্দেশ দিয়াছেন— সংসদ ভবনে ধর্মীয় স্লোগান উচ্চারণ কিংবা কাহাকেও বিপর্যস্ত করিবার চেষ্টা চলিবে না।
একই ঘটনা ঘটিল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভাতেও। চরম দুর্ভাগ্যজনক। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে প্রতিপক্ষকে ধর্মীয় কটাক্ষে বিঁধিবার অস্ত্রটি সংবিধানের প্রতি অপমান। কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে, স্লোগান রাজনৈতিক না কি ধর্মীয় উহা বিচার্য নহে, সংসদ বা বিধানসভায় উচ্চারিত প্রতিটি স্লোগানই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধ্বনিত। সাংসদ ও বিধায়কদের আগ্রাসী ও সংগঠিত আচরণই বুঝাইয়া দেয়, বিপক্ষকে ধরাশায়ী করিয়া দলীয় রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও অনুগামীদের প্রতি বার্তা প্রেরণই মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে বিধেয় কী? নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী হইবার পর দেশের প্রত্যেক নাগরিকের বিশ্বাস অর্জন করিবার কথা বলিয়াছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, এমনকি আপন আপন সংখ্যার জোর বিস্মৃত হইয়া দায়িত্ব পালনের কথাও শুনা গিয়াছিল— উহাই কিন্তু কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় পালনীয়। গণতন্ত্রের প্রতি নাগরিক আস্থা আনিবারও উহাই পথ।
দুর্ভাগ্যের মূল কারণ স্থান-মাহাত্ম্যের অবমাননা। সহজ কথায়, আইনসভায় দেশ পরিচালনার বিভিন্ন আইন লইয়া আলোচনা হইবার কথা। সেই উদ্দেশ্যেই নির্বাচন করিয়া প্রতিনিধিদের সেই স্থলে প্রেরণ করা হইয়া থাকে। উহার পরিবর্তে জনসভার ন্যায় স্লোগানের প্রতিযোগিতা শুরু হইলে তাহা নিঃসন্দেহে রাজপথে পর্যবসিত হয়। তর্ক উঠিতে পারে, বিধায়ক বা সাংসদদের আলাপে কি রাজনীতি আসিবে না? আসিবেই। সেই জন্যই পৃথক পৃথক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু প্রতিনিধিদের আপন বিশ্বাসের জোর আপন নীতি স্থাপন করিবে, গলার জোর নহে। তাহা লইয়া সঙ্কীর্ণ দ্বন্দ্বের স্থানও উহা নহে। কোন মঞ্চের কী প্রয়োজন, তাহা বুঝিয়া লওয়াও বিচক্ষণ রাজনীতিকের দায়িত্ব বইকি। অতএব, সবার আচরণবিধি এবং জনতার রায়কে সম্মান করিতে গেলে প্রাথমিক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতার আস্ফালন, এবং সমরূপ কদর্য প্রতিক্রিয়া দুই-ই বর্জন করিয়া সৎ উদ্দেশ্যে সারগর্ভ আলোচনার অঙ্গীকার করিতে হইবে। কেবল উহার মাধ্যমেই সংবিধানকে উচ্চে তুলিয়া ধরা সম্ভব।