অপরূপ সাজে ঝলমল করছে কনে বৌ, সখীরা উচ্ছ্বাসে মেতেছে। অতিথিদের মুখে হাসি, হাতে উপহার। সুখাদ্য ধরছে কেটারার, খচাখচ ছবি তুলছে ফোটোগ্রাফার। নেই শুধু বর।
ঠাট্টা নয়, এমন ‘সিঙ্গল ম্যারেজ’ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে টরন্টো থেকে টোকিয়ো, সর্বত্র। বিয়ে দিনটা নিয়ে কত স্বপ্ন মেয়েদের, স্রেফ বর খুঁজে না-পাওয়ায় তা কেবল পিছোবে? তাই একা একাই সাধ মিটিয়ে বিয়ে করছে মেয়েরা।
এ রাজ্যে নির্বাচনের তোড়জোড় যেন তেমনই। জনসভার রোশনাই, মিছিলে ব্যান্ডপার্টি, তত্ত্বের ডালার মতো থরে থরে সাজানো প্রতিশ্রুতি। এত কাণ্ড করে যাকে বরণ করার কথা, শাসক-বিরোধী সবার কাছে সেই গণতন্ত্র ফালতু আপদ। আলোচনা? সে কবেই এলেবেলে। বিয়েতে মিতবর।
ভারতের গণতন্ত্রে যদি মখমলের আসনে স্থান হত আলোচনার? পঞ্জাবের সত্তর জন চাষির প্রাণ বেঁচে যেত। কৃষি আইন নিয়ে যে কথাগুলো তাঁদের বলার ছিল, তা শুনতে কেউ রাজি হয়নি। তাঁদের আশঙ্কার নিরসন করতে বলা হয়নি কোনও কথা। তাই এই প্রবল শীতে রাস্তায় রাত জাগছেন দু’লক্ষ চাষি। কেন তাঁদের কথা না শুনেই তাঁদের নিয়ে আইন হবে? এই ক্ষোভ থেকে কখনও রাস্তায় নেমেছেন প্রতিবন্ধীরা, কখনও পরিবেশকর্মীরা, আদিবাসীরা।
রাজ্যেও তাই। একের পর এক প্রকল্পে বিপুল টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, কোনও আলোচনা ছাড়াই। কোথা থেকে টাকা আসবে, ওই টাকা অন্য ভাবে খরচ হলে আরও ভাল হত কি না, বলা-বোঝার সুযোগই হল না। ধরুন ‘স্বাস্থ্যসাথী’-র কথাই। এমন বিমা সব সময়েই প্রাইভেট হাসপাতালে ভিড় বাড়ায়। রাজ্য তার জন্য বারো হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়াল। অথচ, অতিমারিতে প্রাইভেট হাসপাতাল অধিকাংশ শয্যা, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর নিয়েও অনিচ্ছুক প্রেমিকের মতো মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। রোগী ফিরিয়েছে, অত্যধিক বিল করেছে, অনাবশ্যক ওষুধ, টেস্ট করিয়েছে। লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে ‘ভাঙা কুলো’ সরকারি হাসপাতাল। তা হলে টাকাগুলো সরকারি হাসপাতাল পেল না কেন?
হয়তো এ সব প্রশ্নে আইনসভায়, সর্বদলীয় বৈঠকে তুলকালাম হত। শেষে হয়তো দেখা যেত, কেন্দ্রই ঠিক— কৃষি সংস্কার না হলেই নয়। রাজ্যই ঠিক— স্বাস্থ্যবিমা সর্বাগ্রে আবশ্যক। তবু সরকার নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে যে কষ্টটা করত, তাতে সন্দেহের ধোঁয়া একটু সরত। কৃষি আইন মানে কর্পোরেটের হাড়িকাঠে চাষিকে জবাই, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড মানে দেউলিয়ার লেখা চেক— এমন আশঙ্কা সব যুক্তি-তর্ককে ঢেকে দিত না। তা স্পষ্ট হয়নি, ফলে সরকার যা-ই বলছে, উল্টো বুঝছে লোকে। নীতির ভাল-মন্দের তর্ক ছাপিয়ে উঠছে একটাই প্রশ্ন— ধান্দাটা কী?
সরকারের ভাবটা হল, আলোচনা করে কী হবে? কাজ চাই। যদি বা আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে দেয় কেন্দ্র, সঙ্গে ফতোয়া— দশ দিনের মধ্যে মতামত জানাক নাগরিক। ইংরেজি থেকে অতগুলো পাতা অনুবাদ করে, পড়ে-বুঝে, প্রান্তবাসী মানুষের কাছে তার ব্যাখ্যা করে, তর্কের পর সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো— দশ দিন কি এক মাসে। মনে পড়ে, এমআইটি-র অর্থনীতিবিদ পিটার ডায়মন্ড নোবেল পাওয়ার পর (২০১০) সহকর্মীদের দেওয়া পার্টিতে বলেন, “আফ্রিকায় দেখি, মাসাই জনজাতির লোকেরা সিদ্ধান্ত নিতে হলে গাছের নীচে বসে। যত ক্ষণ না সকলে একমত হয়, কেউ ওঠে না। এই ডিপার্টমেন্টে আমরাও তাই করি।” তাঁর কথাটা ভাবিয়েছিল। এমন নয় যে, সবাইকে সহমত হতে হবে। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্তে সবার অংশীদারি থাকতে হবে।
এটা গণতন্ত্রের তত্ত্বকথা নয়, একেবারে কেজো কথা। জেলায় প্রায়ই দেখা যায়, জেলা বা ব্লক স্তরে দু’দলের নেতারা যখন এক সভায় আসতে নারাজ, এমনকি সরকারি মঞ্চেও, তখন পঞ্চায়েত সদস্যরা দিব্যি মিটিং করছেন। আরও দেখা গিয়েছে, যখন কোনও প্রকল্পের অধীনে সংসদ স্তরে কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে জনস্বার্থে কোনও কাজের জন্য, গ্রামের মানুষ মিলে ঠিক করেছেন কিসে টাকা খরচ হবে, তখন অনেক গ্রামে তাঁরা চাঁদা তুলে প্রকল্পের টাকায় যোগ করেছেন নিজেদের টাকা। নেতারা কেউ কাউকে জমি ছাড়তে চান না, তাই (টিভিতে হামেশা দেখা যায়) এক জনের কথার উপর দিয়ে অন্যেরা কথা বলতে থাকেন। গ্রামে দেখি, সবাই বসে কথা বললে তৈরি হয় বিশ্বাসের জমি। দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী বলছেন, স্বাধীনতা মানে পরস্পরের অধীনতা। আমি ওর কথা শুনব, ও আমার কথা, এই বিশ্বাস মানুষকে স্বাধীন করে। গাঁধীর সংগ্রামের যেখানে সূচনা, সেই চম্পারণে তাঁর আন্দোলনের প্রথম বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রতিটি নীল চাষির কথা শোনা। স্বেচ্ছাসেবীরা তা লিপিবদ্ধ করত। একই কাহিনি প্রায় সকলের, তবু কেউ নিজের কথা না বলে ফেরেনি।
অন্যের কথা শোনার ইচ্ছা, নিজের কথা বলার ক্ষমতা, এই হল গণতন্ত্র। তা না থাকলে নির্বাচন, যেন শূন্য মণ্ডপে ঢাকের বাদ্যি। নেতারা কাজের ফিরিস্তি নিয়ে বড়াই করতে এলে তাই জানা চাই, ‘কাজ হয়তো করেছেন, আলোচনা করেছিলেন কি?’