রাখিবন্ধন উত্সব। ফাইল চিত্র।
রাখিবন্ধন উত্সব এ বার যেন কিয়ত্ অধিক গুরুত্বে পালিত হল। সামাজিক পরিসরে এই উত্সবের গুরুত্ব অন্যান্য বছর যে কম থাকে, তা নয়। কিন্তু এ বছর রাখির তাত্পর্য শুধু যেন সামাজিকতায় সীমাবদ্ধ রইল না। দেশ-কাল-সময়-রাজনীতির আঙ্গিকে রাখিবন্ধন এ বার যেন অনেক বৃহত্তর তাত্পর্যের এক উত্সব হিসেবে ধরা দিল।
প্রায় সওয়া শতক আগের একটা সময়েও এই রকম অথবা এর চেয়েও অনেক বৃহত্ তাত্পর্যের এক অনুষ্ঠান হিসেবে দেখা দিয়েছিল রাখিবন্ধন। সে ছিল ব্রিটিশ ভারত, আর ছিল এ প্রিয় স্ব-ভূমিকে ভেঙে দেওয়ার আয়োজন। সে আয়োজন ভেস্তে দিতে সমাজের একটা বড় অংশ পথে নেমে এসেছিল রাখি হাতে নিয়ে। পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কোনও ধর্মীয় রীতি হিসেবে নয়, বৃহত্তর সামাজিকতা হিসেবে, সম্প্রীতির হাতিয়ার হিসেবে এবং ব্রিটিশের কু-রাজনীতির প্রত্যুত্তর হিসেবে সে দিন ধরা দিয়েছিল রাখিবন্ধন।
বঙ্গভঙ্গের আয়োজনের প্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালের সেই রাখিবন্ধনের সঙ্গে ২০১৮-র রাখিবন্ধনের আঙ্গিক হুবহু মেলে না। সে দিনের রাখিবন্ধনকে ঘিরে আবেগের প্রাবল্য যতখানি ছিল, এ দিনের রাখিবন্ধনের সঙ্গে তার তুলনা করা আদৌ উচিত হবে কি না, সে তর্কও তোলা থাক। শুধু খেয়াল করা যাক, সামাজিক পরিসর ছাড়িয়ে রাখিবন্ধনকে ঘিরে এ বার রাজনৈতিক তত্পরতার প্রাবল্য যতখানি দেখা গেল, স্মরণাতীতকালে তার নজির নেই।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
বিজেপি প্রতি বছরই সমারোহে রাখিবন্ধনের আয়োজন করে। রাখিবন্ধন বা রাখিপূর্ণিমা ওই দলের জন্য একটি নির্দিষ্ট সামাজিকতা বা একটি নির্দিষ্ট পরম্পরার অঙ্গ। আয়োজনের ক্ষয় বা বৃদ্ধির কথা বাদ দিলে, বিজেপির জন্য রাখিবন্ধনের আঙ্গিক এ বারও একই।
কিন্তু রাখিবন্ধনকেই বিজেপির ঠিক উল্টো মেরুতে দাঁড়ানোর পন্থা হিসেবে ব্যবহার করল অন্য দলগুলো। তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস— সব দল নিজের নিজের মতো করে রাখিবন্ধন উত্সবে সামিল হল এ বছর। তৃণমূল বা কংগ্রেসের মতো জাতীয়তাবাদী দলগুলোর জন্য এ ধরনের সামাজিকতায় সামিল হওয়া নতুন নয়। কিন্তু যে আড়ম্বর নিয়ে এ বার রাখি হাতে পথে নামল তৃণমূল, তেমনটা আগে দেখা যায়নি। আর সিপিএমের তরফে রাখিবন্ধন নিয়ে এতখানি তত্পরতা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। তৃণমূলের প্রায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পথচলতি জনতাকে রাখি পরাতে দেখা গেল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যকেও। যৌথ পরিকল্পনা নয়, তবু যৌথতার বার্তা এল এক। সামাজিকতায় বা নাগরিক সদ্ভাবে ভাঙন ধরানোর যে কোনও প্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হবে যৌথ ভাবে, প্রতিরোধ হবে বিভেদ ভুলে। এমন এক বার্তা উঠে এল পথ-ঘাট থেকে।
আরও পড়ুন: সবুজ, গেরুয়া, লাল রাখিতে জনসংযোগ
দেশে ভাঙনের আবহ তৈরি করেছে বিজেপি, সামাজিক সুস্থিতি শেষ করতে চাইছে বিজেপি, কোটি মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে— এ রাজ্যের অ-বিজেপি দলগুলোর প্রত্যকটার কণ্ঠস্বর এখন এ কথাই বলছে। কণ্ঠস্বরগুলো মিলে যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে, জোরালো হচ্ছে অতএব। ভাঙার চেষ্টা যদি সত্যিই কোথাও থেকে থাকে, তা হলে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে রুখে দাঁড়াতে হবে, এমন এক বার্তা যাচ্ছে অতএব। প্রায় সওয়া শতকের ব্যবধানে রাখিবন্ধন আবার সেই পুরনো আঙ্গিকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে, এমনটা বোধহয় কয়েকটা দিন আগেও উপলব্ধিতে আসেনি।