প্রতীকী ছবি।
পুলিশই যদি মামলা দুর্বল করিয়া দেয়, তবে ন্যায় মিলিবে কী রূপে? প্রবীণ আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার সম্প্রতি মানবাধিকার সম্পর্কিত একটি বক্তৃতায় সেই প্রশ্ন তুলিলেন। তদন্তে বিলম্ব করিয়া, সাক্ষীকে ভয় দেখাইয়া, নথিপত্র ধ্বংস অথবা আদালতে পেশ না করিয়া অপরাধের প্রমাণ দুষ্কর করিতে পারে পুলিশকর্মীরা। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ইঙ্গিতেই অপরাধীকে আড়াল করিবার এই অপচেষ্টা। কারণ দুর্বোধ্য নহে। আড়াল হইতে চাপ সৃষ্টি করিতে থাকেন রাজনৈতিক নেতারা। দৃষ্টান্তস্বরূপ বৃন্দা গ্রোভার তিন দশক পূর্বের হাসিমপুর গণহত্যার মামলাটি উপস্থাপনা করিয়াছেন। ১৯৮৭ সালে মেরঠে দাঙ্গার পরে বিয়াল্লিশ জন মুসলিম পুরুষকে হত্যা করিয়াছিল উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। অভিযোগ দায়ের হইলেও, ওই পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই। অভিযুক্তরা কর্মরত থাকিলেও তাহাদের ‘নিখোঁজ’ বলা হইয়াছে, গ্রেফতার করা হয় নাই। বহু বিলম্বে চার্জশিট জমা পড়িলেও, উপযুক্ত নথিপত্র পেশ করে নাই পুলিশ। ফলে নিম্ন আদালত নির্দোষ ঘোষণা করে অভিযুক্তদের। অবশেষে দিল্লি হাইকোর্টে সকল প্রমাণাদি পেশ করিতে বাধ্য হয় পুলিশ। গত বৎসর ষোলো জন অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হইয়াছে। বৃন্দার মতে, ইহা পুলিশের দায়বদ্ধতার অভাবের দৃষ্টান্ত। মুসলিম, দলিত-আদিবাসীকে নিপীড়ন করিতে অভ্যস্ত রাষ্ট্র। পুলিশের অভ্যাস সাক্ষ্য নষ্ট। উচ্চপদস্থ পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করিবার কোনও উপায় নাই।
এই আক্ষেপ বহু বার, নানা ঘটনার মাধ্যমে নাগরিক অনুভব করিয়াছে। প্রভাবশালী নেতা এবং আজ্ঞাবাহী পুলিশের যুগলবন্দি বিচারব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করিবার উপক্রম করিয়াছে। জেসিকা লাল হত্যায় মনু শর্মা, ছয় ব্যক্তি হত্যার মামলায় সঞ্জীব নন্দা অভিযুক্ত হইয়াও প্রমাণের অভাবে মুক্তি পাইয়াছিলেন। জনরোষের চাপে পুনরায় বিচার এবং দোষী সাব্যস্ত হইবার ঘটনা বিচারব্যবস্থা লইয়া সংশয়ের কালিমা গাঢ়তর করিয়াছে। সম্প্রতি সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ মামলায় সাক্ষ্যের অভাবে সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দিয়া আক্ষেপ করিয়াছেন স্বয়ং বিচারক। ভারতীয় আদালতে বিচারপতির কণ্ঠে এমন আক্ষেপ এই প্রথম নহে। অথচ পুলিশকর্মীদের রাজনৈতিক চাপমুক্তির প্রক্রিয়া বহু পূর্বেই নির্দিষ্ট হইয়াছে। এক প্রাক্তন পুলিশ অধিকর্তার মামলার ভিত্তিতে ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট পুলিশব্যবস্থায় সংস্কারের এক বিস্তারিত নির্দেশ দিয়াছিল। তাহার মূল কথা, সকল রাজ্য সরকার একটি ‘রাজ্য সুরক্ষা কমিশন’ গঠন করিবে, যাহাতে বিরোধী নেতা এবং স্বাধীন নাগরিকও থাকিবেন। ‘ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ’ পদটিতে নিয়োগ হইবে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে, এবং তাঁহাকে শীর্ষে রাখিয়া গঠিত একটি বোর্ড সকল পুলিশকর্মীর বদলি, পদোন্নতি, শাস্তি প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করিবে। এই ভাবেই তদন্তরত পুলিশের সহিত নেতাদের দূরত্ব নিশ্চিত করিবে কমিশন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বাস্তবে কী হইয়াছে? কাগজে-কলমে প্রায় সকল রাজ্যই কমিশন গঠন করিয়াছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাহাকে স্বাতন্ত্র্য বা ক্ষমতা দেয় নাই। পশ্চিমবঙ্গে যে এমন একটি কমিশন রহিয়াছে, বহু পুলিশকর্তাও সম্ভবত তাহার সন্ধান রাখেন না। পুলিশের নীতি-নিষ্ঠার সুনাম নাই, কিন্তু সকল পুলিশকর্মী দলদাস হইয়া সুখী, এমনও নহে। অনেকেই অসহায়। বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত মামলার তদন্ত লইয়া সিবিআই এবং রাজ্য পুলিশের সাম্প্রতিক সংঘাত স্মরণীয়। নাগরিকের মনে বারংবার প্রশ্ন জাগে— তদন্তের উদ্দেশ্য কি সত্যের প্রকাশ, না কি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অস্ত্র জুগাইবার কাজটি সম্পাদন করিবে পুলিশ? নাগরিকের আস্থা বজায় রাখিতে পুলিশে সংস্কার আনিতে হইবে। মন্দ ব্যবস্থায় ভাল পুলিশ হইতে পারে না।