মানুষ তো ভরসা রাখতেই চায়

পুলিশ প্রশাসন চাইলে এই অনাচার বন্ধ করা কঠিন নয়

ভদ্রলোককে দেখে কষ্ট হচ্ছিল। ওরা তাঁর গায়ে হাত তোলেনি, হালের বঙ্গসমাজের মাপকাঠিতে বিচার করলে খুব একটা গালিগালাজও করেনি, তুইতোকারিও নয়— আপনি করেই কথা বলছিল। কিন্তু ভদ্রলোক যখন খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল টেলিফোনে ছেলেকে বলছিলেন, ‘‘তুই কী করলি বল তো!

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

ভদ্রলোককে দেখে কষ্ট হচ্ছিল। ওরা তাঁর গায়ে হাত তোলেনি, হালের বঙ্গসমাজের মাপকাঠিতে বিচার করলে খুব একটা গালিগালাজও করেনি, তুইতোকারিও নয়— আপনি করেই কথা বলছিল। কিন্তু ভদ্রলোক যখন খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল টেলিফোনে ছেলেকে বলছিলেন, ‘‘তুই কী করলি বল তো! তোকে কত বার বলেছি ও-সব লিখিস না, আর তোর ওই পোস্টের জন্যে আজ আমাকে এই ভাবে... তুই তো জানিস আমি এখানে চিরটাকাল কী ভাবে থেকেছি...’’, তিনি কাঁদছিলেন না, চিৎকারও করছিলেন না, তাঁর গলায় ঝরে পড়ছিল একটা অসহায় বেদনা, অপমানিত হওয়ার বেদনা— খুব কষ্ট হচ্ছিল দেখে।

Advertisement

কষ্ট হচ্ছিল ভদ্রমহিলাকে, এবং তাঁর তরুণ ছেলেকে দেখেও। বাড়িতে চড়াও হয়ে ছেলেটিকে ওরা নাগালে পেয়ে যায়, তার শাস্তি হাতে হাতে চুকিয়ে দিতে হবে। বাড়িতে নয়, রাস্তায়, কারণ ‘যা হবে সকলের সামনে হবে’। অতএব ‘অপরাধী’কে নিয়ে রাস্তায় নামে তাজা ছেলেদের দঙ্গল, তার গায়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে দেশপ্রেমের শোরগোল তুলে হাঁটতে থাকে মোড়ের দিকে, চৌমাথাই তো চিরকাল গণ-শাস্তির শ্রেষ্ঠ মঞ্চ। বাড়িতে আদুড় গায়ে ছিল ছেলেটি, সেই অবস্থাতেই তাকে বার করে এনেছে ওরা, যানবাহন চলাচল রুখে দিয়ে বিচারসভা বসিয়েছে চৌমাথার মোড়ে, অতঃপর রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে কান ধরে ওঠবোস করে ছেলে, জোরে জোরে বলে ‘ভারতমাতা কি’, চার পাশ থেকে দেশপ্রেমীরা হাঁক দেয় ‘জয়’। সুর মিলিয়ে চলতে থাকে ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’। পিছনে দাঁড়িয়ে ছেলের লাঞ্ছনা দেখেন অসহায় ভদ্রমহিলা, চোখেমুখে গভীর উদ্বেগ, শোনা যায় তাঁর মনের আর্তনাদ— ‘কী করলি বল তো!’

— গত দু’দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘দেশদ্রোহী’র জাতীয়তাবাদী শাস্তির দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে যে কষ্টটা বার বার অনুভব করেছি, সেটা লাঞ্ছনার। শারীরিক লাঞ্ছনার পাশাপাশি, হয়তো তার চেয়েও বেশি করে, মানসিক লাঞ্ছনার। সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারে মানুষ অনেক রকমের সমস্যা নিয়ে, অনেক দৈনন্দিন গ্লানি আর অপমান সহ্য করে, অনেক অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে বেঁচে থাকে। বিরাট মর্যাদা-টর্যাদা আর ক’জন পায়, কিন্তু একটা কাজ-চালানো আত্মসম্মান সম্বল করে দিন কাটে। সেই জীবনযাত্রায় হঠাৎ কিছু লোক দল বেঁধে চড়াও হলে, ভাঙচুর করলে, ‘কেন সেনাবাহিনীর নামে খারাপ কথা লিখেছিস’ বলে দেশদ্রোহী তকমা লাগিয়ে চড়থাপ্পড় দিয়ে, গালিগালাজ করে, রাস্তায় নামিয়ে ‘ভারতমাতা কি জয়’, ‘ইন্ডিয়ান আর্মি জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি বলে চেঁচাতে বাধ্য করে সর্বসমক্ষে লাঞ্ছনা করলে সেটা কেবল সাময়িক আঘাত হয়ে থাকে না, তার গভীর ক্ষত থেকে যায় বাকি জীবন জুড়ে। এমন অভিজ্ঞতা বিশেষ করে কমবয়সিদের আত্মবিশ্বাসে বড় রকমের ধাক্কা দিতে পারে, সেটা বোঝার জন্য মনস্তত্ত্ববিদের কাছে না গেলেও চলে।

Advertisement

কাশ্মীরের পুলওয়ামায় পৈশাচিক সন্ত্রাসে অর্ধশত নিরাপত্তারক্ষীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থেকে এ রাজ্যের অনেক তরুণতরুণী এবং তাঁদের অভিভাবক আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা যূথবদ্ধ আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা দেশের শাসক এবং তাঁদের অতিজাতীয়তার ধ্বজাধারীদের সুরে সুর না মিলিয়ে এই সন্ত্রাস উপলক্ষে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের যে সব মন্তব্য নিয়ে আক্রমণকারীদের রাগ, সেগুলি, যতটা দেখেছি, তাতে রাষ্ট্রদ্রোহের কোনও লক্ষণ নেই— সরকারের বা শাসকদের মতের বিপরীত মত মানে যদি রাষ্ট্রদ্রোহ হয় তা হলে দেশে কোনও বিরোধী মতই থাকতে পারে না। তার পরেও, তর্কের খাতিরে বলতে হয়, কারও কোনও মত দেশের আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের কোটায় পড়ে কি না, সে বিচার আদালতের হাতে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আদৌ কেন থাকবে, সেই অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নও আপাতত ঊহ্য থাকুক। কিন্তু এ-সব প্রশ্ন এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, কারণ দেশপ্রেমের এই স্বনিযুক্ত (বা নেপথ্য-চালিত) ঠিকাদাররা আইন-আদালতের কিছুমাত্র পরোয়া করে না, তারাই স্থির করে কে অপরাধী, তারাই ঠিক করে কী তার শাস্তি, এবং তারাই সেই শাস্তি তৎক্ষণাৎ মিটিয়ে দেয়। বস্তুত, সন্ত্রাসীদের ঘৃণ্য চক্রান্ত এবং হিংসার বলি হলেন যে জওয়ানরা, বিপর্যস্ত হলেন তাঁদের যে সমস্ত পরিবার পরিজন, সেই মানুষগুলির প্রতি সমবেদনার যথার্থ কোনও লক্ষণ এই আক্রমণকারীদের আচরণে দেখা যায়নি, তারা ক্ষমতা দেখাতেই চড়াও হয়েছে, ক্ষমতা দেখিয়ে চরিতার্থ হয়েছে।

কিন্তু প্রশাসন? পুলিশ? কয়েক দিন ধরে, বিশেষত অশান্তির প্রথম পর্বে তাদের আচরণ দেখলে অ্যালিস বলত: কিউরিয়সার অ্যান্ড কিউরিয়সার! একাধিক নজির রয়েছে হাতের কাছেই, যেখানে আক্রমণকারীদের শাস্তি না দিয়ে পুলিশ আক্রান্তদেরই তুলে নিয়ে গিয়েছে, আটক করে রেখেছে, তাদের এবং তাদের বাড়ির লোকের দুশ্চিন্তা দূর করার বদলে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। শিষ্টের দমন এবং দুষ্টের পালনে, অন্য অনেক রাজ্যের মতোই, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ অনেক দিনই বেশ দড়। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের বিরোধী বলে পরিচিত প্রশাসন হিন্দুত্ববাদী উপদ্রব দমন না করে কার্যত তাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলবে, এটা কিঞ্চিৎ বিস্ময়কর বইকি! প্রশাসনের চালকরা কি ভয় পেয়েছিলেন যে, বেশি কড়া হাতে এই তাণ্ডব দমন করতে গেলে তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে লোকের মনে প্রশ্ন উঠবে এবং তাতে ভোটের বাজারে লোকসান হবে? না কি, চালকদের তোয়াক্কা না করে পুলিশবাহিনীর নানা স্তরের শিরা ও ধমনীতে প্রবাহিত জঙ্গি জাতীয়তাবাদ আপনবেগে পাগলপারা?

অথচ পুলিশ প্রশাসন প্রথম থেকে যথেষ্ট সক্রিয় হলে এই সব অনাচার বন্ধ করা কঠিন নয়। যারা কোনও একটা অছিলায় দল বেঁধে সাধারণ মানুষের উপর উৎপাত করে, এবং অন্তরালে থেকে যে রাজনীতিবাজরা তাদের প্ররোচনা ও রসদ জোগায়, প্রশাসনের দুর্বলতাই তাদের স্পর্ধার প্রধান উৎস। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এরা দল পাকিয়ে গৃহস্থের বাড়িতে চড়াও হয়, চৌরাস্তার মোড়ে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে সাধারণ নাগরিকের উপর অত্যাচার চালায়। শাসকরা সত্যিই চাইলে এদের সহবত শেখাতে বেশি সময় লাগার কোনও কারণ নেই। শুরু থেকে কঠোর হলে দ্রুত এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসেই অনেক বার দেখা গিয়েছে— অনেক দাঙ্গা-পরিস্থিতি প্রশাসনের সুস্পষ্ট নির্দেশে চালিত পুলিশের তৎপরতায় সামাল দেওয়া হয়েছে। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থায় যে পুলিশ দলদাস, তাকেই সাম্প্রদায়িক অশান্তি দমনে কঠোর ও নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার স্বাধীনতা দিলে চটপট সাফল্য আসে, এটাও পরীক্ষিত সত্য।

বস্তুত, সে ক্ষেত্রে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও মনের জোর পেয়ে দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন, দাঁড়ানও। কলকাতায় তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চলেই তেমন সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের একটা ধারা পরিচিত ছিল। দুষ্কৃতীরা দুষ্কর্মে মাতলে তার মোকাবিলায় পাড়ায় পাড়ায় নাগরিকরা একজোট হতেন। প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে তাঁদের কার্যকর যোগাযোগ থাকত। এ ধরনের নাগরিক সংহতিতে অনেক ক্ষেত্রেই দলতন্ত্রের প্রভাব পড়ত, সেই প্রভাব নানা সমস্যা এবং অন্যায়েরও কারণ হয়ে উঠত, কিন্তু দ্রুত বিপদ রুখতে তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ভূমিকা ছিল সামাজিক শুভবুদ্ধির সংহতিকে ধরে রাখতেও, যে সংহতি একটা সুস্থ সমাজকে আত্মবিশ্বাস দেয়, যে আত্মবিশ্বাস আবার প্রশাসনকে ঠিক পথে রাখবার প্রেরণা দেয়, ঠিক পথে থাকতে সাহায্য করে।

কিন্তু প্রশাসন নিজে সবল না হলে তেমন নাগরিক উদ্যোগ গড়ে তোলা কঠিন, ধরে রাখা আরও কঠিন। প্রশাসনকে পাশে না পেলে, পুলিশের সহযোগিতার উপর ভরসা রাখতে না পারলে, শুভবুদ্ধি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেই। গত কয়েক দিনেও তার নানা নিদর্শন দেখা গিয়েছে, অনেকেই অন্যায়ের প্রতিরোধে এগিয়ে গিয়েও পরে পিছিয়ে এসেছেন, সম্ভবত প্রশাসনের সহযোগিতার উপর যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারেননি বলেই। আবার, উল্টোটাও দেখেছি— পুলিশ তৎপর হলে নাগরিকরাও তৎপর হয়েছেন, আক্রান্তের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আক্রমণ প্রতিহত হয়েছে। কিন্তু এই কারণেই প্রথম রাতে তৎপর হওয়া জরুরি। যূথবদ্ধ অন্যায় এক বার প্রশ্রয় পেলে তাকে বাগে আনার সমস্যা বাড়ে।

প্রথম রাতে না হলেও, খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে মনে হয়, এই নির্দেশের পরে পুলিশের নড়াচড়া কিছুটা বেড়েছে। ভরসা থাকুক, যূথশক্তির দাপটে যারা মাৎস্যন্যায় চালিয়েছে বা চালাতে যাবে, তাদের শাস্তি হবে। ভরসা থাকুক, আর কোনও তরুণতরুণী এবং তাদের প্রিয়জনকে এমন ভাবে লাঞ্ছনা সহ্য করতে হবে না। কিন্তু সেই ভরসার মর্যাদা রাখতে চাইলে, মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর প্রশাসনকে ষোলো আনা সতর্ক এবং তৎপর থাকতে হবে। কারণ, নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে ভোট আসছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement