এত কিছুর পরও আমাদের মনে আবেগের জায়গাটা কেমন যেন একটু নড়ে ওঠে! হাজার যুক্তির ভিড়েও আবেগ একটা অন্য মাত্রা নেয়।
বয়স তখনও শৈশবের গণ্ডি পেরোয়নি। দোলের পরে ঠিক সময়ে নতুন জামাকাপড় কেনার নেশাটা ঠিক জেগে উঠত। বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করার আমেজটা অন্য রকম ছিল। আর তার চেয়েও মজার বিষয়টা ছিল পয়লা বৈশাখ সকাল-সকাল স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পড়ে নেওয়া। রাস্তায় বেরোলেই দেখতাম, পাড়ার প্রায় সকলেই নতুন নতুন সাজে নিজেকে আবৃত করেছে। রান্নাঘরে সে দিন মা নানান ধরনের খাবার রান্না করতে ব্যস্ত। পায়েস থেকে শুরু করে পাটিস্যাপ্টা— সেদিন পেট সবই হজম করে নিতে পারত!
সে দিন বাড়িতে আত্মীয়দের ভিড়ও জমত। কিন্তু সময় সব কিছু মুছে দেয়। আর এই সময়ের গা ঘেঁষেই জন্ম নেয় নতুন আলোড়ন। নবীন প্রজন্ম নিজের মতো করে সাজিয়ে নেয় নিজেদের সমাজ আর সংস্কৃতি। তাই বলে একটা দশক পেরোতে না পেরোতেই একটা সমাজবিধি এ ভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে? আজকের পয়লা বৈশাখ কেমন যেন মনমরা! সরকারি ছুটি ছাড়া আর বোধ হয় এমন কিছু নেই, যেটা আমাদের মনে করিয়ে দেবে— আজ অন্য একটা দিন! বাঙালির ঘরে ঘরে যে রবটা এক সময় হইচই করে বেড়াত, সেটা কি হারিয়ে গিয়েছে, না কি আমরা ধরে রাখিনি? হয়তো ধরে রাখতেও চাই না আমরা!
একটা নতুন বছর হয়তো আদতে কিছুই না। বছর তো একটা বৃত্ত মাত্র, তারই একটা বিন্দু এই প্রথম দিনটা। কিন্তু তার পরও সব কিছু যেন নতুন করে শুরু করা, পুরনো সব ভুলভ্রান্তি মুছে দেওয়ার সংকল্প— এগুলোই হয়তো আমাদের উৎসাহ দেয়। দৈনন্দিন জীবনে কিছু নতুন স্রোত এনে দেয়। ইংরেজি বছরের মতো বাংলা সালটাও বোধ হয় আমাদের নতুন করে ভাবার একটা মাধ্যম হতে পারত, হয়তো ছিলও এক সময়। বাংলা মাস, তারিখ তো আমরা ভুলেই গিয়েছি! অন্তত বছরের একটা দিন আমরা তো এটাকে ধরে রাখতেই পারতাম!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আবেগ আর অভ্যাসের দৌড়ে বোধ হয় অভ্যাসই সব সময় রাজত্ব করে এসেছে। আর কিছুটা প্রয়োজনীয়তা! আসলে, মানুষের স্বভাব হল, সব সময় সব কিছুকে সহজ করা। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সিমপ্লিফিকেশন’। সমাজতত্ত্ব থেকে শুরু করে বিজ্ঞান— সব শাখাতেই এই কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান চায় সমস্ত তত্ত্বকে যতটা সম্ভব সহজ করতে। সেগুলোকে সহজ সুত্রের মধ্যে বেঁধে দিতে। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘একতা’ কথাটা। না, এটা সেই ছোটবেলার নীতিকথামূলক গল্পের একতা নয়। এটা ‘ইউনিফিকেশন’। সমস্ত কিছুকে একটা সূত্রের মধ্যে নিয়ে আসা। অথবা দু’টো পৃথক সূত্রের মধ্যে মিল খুঁজে বার করা। এতে কী হয়? মনে রাখার সুবিধা হয়। চর্চা করাও সহজ হয়। যেমন, সেলফোনের একটা অ্যাপের মাধ্যমেই যদি আমরা ট্রেনের টিকিট কাটা, পোশাক কেনা, রেস্টুরেন্টের বিল পেমেন্টের মতো অনেকগুলো কাজ করতে পারি, তাহলে দৈনন্দিন জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়। এই সহজ করতে করতেই আমরা একই রকম দু’টো জিনিস থাকলে একটাকে বাদ দিয়ে দিই।
এমনই ঘটেছে বাংলা নববর্ষের ক্ষেত্রে। যেহেতু এখন সমস্ত কিছুই ইংরেজিতে হয়, উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কের কাজ, মোবাইলের সার্চ অপশন থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া বা সমস্ত অফিসিয়াল কাজকর্ম, তাই বাংলাটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে! আর এই জন্যই দু’টো নববর্ষের মধ্যে আমরা বেছে নিলাম ইংরেজিটাকেই। আরেকটা কারণ হল, বাংলা পয়লা বৈশাখটা কেবল আমরা বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হাতে গোনা অন্য কয়েকটা রাজ্যের মানুষ ছাড়া আর তো কেউ এটা পালন করবেন না! কিন্তু জানুয়ারির প্রথম দিনটা সারা পৃথিবী জুড়ে এক সঙ্গে পালিত হয়। টিভিতে দেখানো হয় অন্য দেশের উদ্যাপন। শহরের রাস্তায় নানা ভাষাভাষী লোক সমবেত হন। এই একাত্মতা বা এক সঙ্গে মিশে যাওয়ার দৌড়েই বাঙালিরাও মিশে গেল বিশ্বসাথে!
এ কথা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না যে, বিশ্বায়নের যুগে যদি আমরা নিজেদের পৃথক করে রাখি, তাতে আদতে আমাদেরই ক্ষতি। আমাদের সামিল হতেই হবে পৃথিবীর সঙ্গে। আর এই কর্মব্যস্ততার যুগে সত্যিই হয়তো আমাদের সময় নেই এত উৎসবের কথা ভাবার। বাংলা ভাষার গৌরব যেমন কমছে, ঠিক তেমনই কমছে আমাদের সংস্কৃতির গৌরব। আমরা ব্যস্ত হতে হতে ভুলেই যাচ্ছি নিজেদের অনেক ঐতিহ্যকে। অথবা বলা যায়, সারা বিশ্বের ঐতিহ্যগুলো মিলে গিয়ে নতুন কিছুর জন্ম দিচ্ছে। আসতে আসতে হয়তো মুছে যাবে ভাষা-জাতি-ধর্মের ব্যবধান। এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে দিয়েই হয়তো কিছু ‘কালচার’ মরে যাবে, আবার কিছু নতুন করে জন্ম নেবেও কিছু। তবে এবার যেটা জন্ম নেবে, সেটা আর কোনও নির্দিষ্ট ভাষাভাষীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে থাকবে সারা বিশ্বে।
এত কিছুর পরও আমাদের মনে আবেগের জায়গাটা কেমন যেন একটু নড়ে ওঠে! হাজার যুক্তির ভিড়েও আবেগ একটা অন্য মাত্রা নেয়। তাই বোধ হয় আমেরিকায় থাকা প্রবাসী বাঙালি যখন রাস্তাঘাটে-অফিসে কোনও বাঙালি মুখ দেখতে পান, তখন অন্য একটা অনুভুতি কাজ করে তাঁর মনে। আবেগ দিয়েই হয়তো এই টানকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। আর হাজারো যুক্তির মধ্যেও মন তাই অন্য কথা বলে। মনে হয় কৃত্তিমতার যুগে এই সামান্য আবেগটুকু বেঁচে থাক!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)