আমার খুব ভাল লাগে কলকাতা যেতে ওই শহরটার দিনরাত, চিৎকার, একটু সেকটু নোংরা রাস্তাঘাট, ভিড়, এলোমেলো ট্রাফিক, ফুচকা, আলুকাবলি, এগরোল, এই সব কিছুর মধ্যে আমি একটা কমফোর্ট জোন খুঁজে পাই।
আমি বাংলা মোটামুটি বলতে পারি। অনেকটাই বুঝতে পারি। আস্তে ধীরে হলেও, বাংলাটা লিখতে, পড়তেও পারি। কিন্তু আমি মনে করি, এগুলো বাইরের ব্যাপার। এটা ঠিক যে, বাংলাভাষাটা বাঙালি হিসাবে আমার আইডেন্টিটি ধরে রাখে। কিন্তু বাঙালিয়ানাটা এক্কেবারে অন্য ব্যাপার।
কী সেটা? আমি ৬ বছর বয়সে আমার জন্মস্থান কলকাতা ছেড়ে আমেরিকা চলে এসেছি। এখন আমার বয়স ২১। এত দিন ধরে আমি আমেরিকাতে বড় হয়েছি, পড়েছি, বন্ধুত্ব করেছি। একটা পুরোপুরি ডিফারেন্ট কালচার, অন্য ভাষা, আলাদা অ্যাকসেন্ট। এত কিছুর পরেও কিন্তু এখনও আমার বাংলা বলতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছেটাই বাঙালিয়ানা।
আমি দুই বছরে এক বার করে কলকাতা যাই। আমার খুব ভাল লাগে কলকাতা যেতে ওই শহরটার দিনরাত, চিৎকার, একটু সেকটু নোংরা রাস্তাঘাট, ভিড়, এলোমেলো ট্রাফিক, ফুচকা, আলুকাবলি, এগরোল, এই সব কিছুর মধ্যে আমি একটা কমফোর্ট জোন খুঁজে পাই। আমি বলব, আমার এই কমফোর্ট আসলে আমার বাঙালিয়ানা।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আমি কলকাতা গেলে মজা করে বেশ কিছু চালু বাংলা বলি, বেশ লাগে। যেমন, ‘ঝাড় খেলাম’, ‘বোঝে বেশি’, ‘পাগলাখ্যাপা’, ‘পিল পিল করছে লোক’, ‘ঘেঁটে গেছে’, ‘খচে ব্যোম’, ‘ভাট বকে’! একটা অদ্ভুত বিষয়, বাঙালিরা ‘পুজো আসছে’ বললেই ধরে নিতে হবে দুর্গাপুজো! আবার ডিসেম্বরের শেষে কোনও বাঙালি যদি বলে ‘মেলায় যাব’, তার মানে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা। তেমনই জানুরারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে কোনও বাঙালি যদি বলে ‘মেলায় যাব’, তার মানে বইমেলা। এই ব্যাপারগুলো আমার খুব ফানি লাগে।
আমি কলকাতা গেলে চুটিয়ে শাড়ি পরি, গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে কেনা গয়না পরি, বাঙালি সাজে সাজি। এ সব করলে আমার কেমন যেন একটা আপন আপন ফিলিং হয়। আমার মতে, এই ফিলিংটাই হল বাঙালিয়ানা। আর এটা সব সময় থাকে আমার বুকের ভিতরে, আমার মাথার ভিতরে। এটা বাইরের কিছু নয়।
বাঙালিয়ানাটা আমার ভিতরে আছে বলেই আমি আমেরিকাতেও বাঙালিদের কোনও উৎসব অনুষ্ঠান হলে শাড়ি পরি। আমেরিকানরা দেখে বলে, ‘কী কিউট, কী গরজিয়াস’। বিদেশিদের এই প্রশংসাটাই আমার কাছে বাঙালিয়ানা। আমি এখন ইতালিতে এসেছি মাস চারেকের জন্য পড়াশোনা করতে। এই তো সে দিন আমরা বন্ধুরা মিলে পিসার লিনিং টাওয়ার দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমি আমার আমেরিকান বন্ধুদের পাপড়িচাট খাওয়ালাম। ওরা তো পুরো ফ্যান হয়ে গেল। ওদের চোখ মুখ দেখে আমার তখন খুব গর্ব হল। বিদেশে থেকে এই গর্বটাই আমার বাঙালিয়ানা।
আরও পড়ুন: ১৯১১ সালেই ‘জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে’ গানটি রচিত ও গীত হয়েছিল
এ রকম কিছু গর্বের মুহূর্তে আমি মনে মনে একটা বাংলা গান গুনগুন করে গাই। ‘বাংলা’ নিয়ে তৈরি এই গানটা আমাদের আমেরিকার বাড়িতে খুব বাজানো হয়, ‘আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’!
বাবা-মা আমার সঙ্গে সব সময় বাংলাতে কথা বলে। ওরা আমাকে জন্মের পর থেকে কলকাতায় কাটানো আমার ৬ বছরের সব গল্প শোনায়।
এই বাড়ির কথায় মনে পড়ে গেল, এই যে আমার বাঙালিয়ানা, বাংলার ব্যাপারে আমার যে এই অ্যাফিনিটি, এটা আমি পেয়েছি আমার বাড়ি থেকেই। ইনহেরিট করেছি বলা যায়, আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে। বাবা-মা আমার সঙ্গে সব সময় বাংলাতে কথা বলে। ওরা আমাকে জন্মের পর থেকে কলকাতায় কাটানো আমার ৬ বছরের সব গল্প শোনায়। কোনও কোনও ছুটির দিনে দুপুরে খাওয়ার পরে বাবা, মা আর আমি পুরনো ফ্যামিলি অ্যালবাম নিয়ে বসি। সন্ধ্যাবেলা কফি খেতে খেতে বাংলা মুভি দেখি, দেখার পরে রিভিউ করার সময় আমরা সবাই মিলে ঘাড় ঝাঁকিয়ে তর্ক করি। কলকাতা গিয়ে আমরা বাংলা গ্রুপ থিয়েটার দেখি। আমি আমেরিকাতে যেমন লোকাল গ্রুপ থিয়েটার করি, তেমনই আবার আমার কমিউনিটির হয়ে বাংলা নাটকও করি। এগুলো আমার মধ্যে একটা বেঙ্গলি ওরিয়েন্টেশন তৈরি করে দেয়, যেটাকে আমি বাঙালিয়ানা বলে ডিফাইন করব।
সত্যি কথা বলতে কি, বাইরে থেকে দেখলে বাংলা বা বাঙালি ব্যাপারটা তো একটা অরগনাইজেশনাল কনসেপ্ট। অনেকটা ইডিওলজির মতো। আর ভিতরের কথাটা হল, ওই আইডিয়াটার মধ্যে একটা সোল বা স্পিরিট থাকে। বাংলায় যেটাকে আত্মা বলা যায়। সেটাই তো বাঙালিয়ানা। আমার বাবা মা ওটার ব্যাপারে একটা অ্যাফিনিটি ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার ভিতরে। কী ভাবে? আমার বাবা কবি, লেখক। বাংলা লিখতে খুব ভালবাসে। বাবা যখনই কিছু লেখে আমাকে পড়ে শোনায়। সবটা বুঝি না, কিন্তু আমার ভিতরে একটা ইনটিগ্রিটি গড়ে ওঠে। আমি বুঝতে পারি যে, আমি একটা বাঙালিয়ানার মধ্যেই এক্সিস্ট করি। আমার দু’টো ইংরেজি কবিতার বই আছে, একটা আমেরিকা থেকে বেরিয়েছে বছর তিনেক আগে। আর একটা রিসেন্টলি বেরিয়েছে কলকাতা থেকে। এই দুটি বইয়েই কলকাতায় কাটানো আমার শৈশবের মেমোরি উঠে এসেছে। এই দুটি বইয়েই আমি আমার ভিতরের বাঙালিয়ানাটাকে এক্সপ্রেস করেছি। কলকাতা থেকে বেরনো বইটায় আমি আমার বাবার লেখা তিনটি কবিতা ট্রানস্লেট করেছি। ভাল বাংলা না জেনেও আমি কী ভাবে সেটা পারলাম? আমি যখনই কোনও ইংরেজি কবিতা লিখে বাবাকে পড়ে শোনাই, বাবা তখনই আমাকে কাছাকাছি থিমের কোনও বাংলা কবিতা পড়ে শোনায়। তখনই আমি রিয়ালাইজ করি যে, এটাই আমার এক্সিসটেন্স, এটাই আমার বাঙালিয়ানা।
আমার মায়ের কথা বলতেই হবে। মা নাচে-গানে খুব ভাল। সেই ইনফ্লুয়েন্সেই আমি ভরতনাট্যম শিখেছি কলকাতাতে, এমনকি আমেরিকাতেও। এক সাউথ ইন্ডিয়ান প্রফেসরের আমেরিকান বউয়ের কাছে। বছর পাঁচেক আগে আমার লেখা, সুর করা আর গাওয়া গানের একটা অ্যালবাম বেরিয়েছিল আমেরিকাতে। সারপ্রাইজিংলি, আমেরিকাতে ছোটবেলা থেকে ওয়েস্টার্ন গানবাজনা শেখার পরেও,আমার অ্যালবামের গানগুলির মধ্যেও কেমন করে যেন একটা বাঙালিয়ানার ইনডিরেক্ট ইম্প্রেশন চলে এল! আসলে আমি তো মায়ের গান শুনে বড় হয়েছি। মন ভাল বা খারাপ থাকলেই মা বাড়িতে হারমোনিয়ম নিয়ে গান করতে বসে পড়ে, মেনলি রবীন্দ্রসঙ্গীত। ওই যে, ওই গানটা, ‘অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে’! সারটেনলি বলছি, ওই ‘অন্তরের আলো’টা থাকলে, বিদেশে বসেও বাঙালিয়ানাটা ফিল করা যায়। আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
আরও পড়ুন: গড়ে তুলি বাঙালির ‘জাতীয়’ বা ‘ন্যাশনাল’ ইতিহাস ও সংস্কারের উদ্যোগ
আমি এখন নিজেই বুঝতে পারি যে, আমি ছবি তুলতে গেলে, ছবি আঁকতে গেলে, আপনা থেকেই কেমন একটা ‘বাঙালি বাঙালি’ ব্যাপার পেয়ে বসে আমাকে। কিছু দিনের মধ্যেই আমেরিকাতে আমার একটা কবিতার অ্যালবাম বেরোবে। অডিও কোলাজের মতো। তাতে আমি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের মতো করে মায়ের গাওয়া রবি ঠাকুরের গান ইউজ করেছি, ‘কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ’! বাবার লেখা কবিতা বাবাকে দিয়ে বলিয়েছি। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটাও দিয়েছি একটু। আবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গানও ইনপুট করেছি, ‘কতদিন পরে এলে একটু বসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল, যদি শোনো’! এই যে এই ব্যাপারগুলো আমি পেলাম, সেটা কিন্তু একটা ইনহেরিট্যান্স। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতা আছে না, ‘নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ’। উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারটাই আমার বাঙালিয়ানা।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর ১৯১১
এই বাঙালিয়ানাটাকে আমি খুব বেশি করে টের পাই যখন আমি আমেরিকায় আমার চারপাশটায় তাকাই, যখন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি। যখন স্কুলে, কফিশপে, মলে, বইমেলায় ভিড় করে থাকা মানুষজনকে দেখি। আমার স্পষ্ট মনে হয়, ঠিক এই সব নয়, আমার ভিতরে একটা অন্য কিছু আছে। মুকুলের যেমন সোনার কেল্লার কথা মনে পড়েছিল, আমার তখন ঠিক তেমনি করে মনে হয়, কলকাতার সঙ্গে আমার কোথায় যেন একটা মিল আছে। একটা প্যারিটি, একটা সিমিলারিটি। আমেরিকাকে আমি খুব চিনি, কিন্তু কেন যেন মনে হয়, কলকাতাকে আমি আরও বেশি চিনি। যত বড় হচ্ছি, আমার ভিতরে ততই ওই চেনা কলকাতাটা জেগে উঠছে। কোথা থেকে এলাম আমি? আমি সেখানে যেতে চাইছি। আমার শিকড়ের দিকে। একটা ইনার জার্নি।
এই বাঙালিয়ানার তাগিদেই আমি খুব মজা করে কলকাতায় যাই। গিয়ে দাদাই দিদাইয়ের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিই। গাঁতিয়ে মাছ খাই, পাটিসাপ্টা নারকেলের নাড়ু খাই। আমার তুতো ভাইবোনেরা ওদের মা-বাবার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে আসে, আমরাও যাই ওদের বাড়ি। মা বাবা ওদের বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে লেপটে থাকে।মা-বাবার সব বন্ধুবান্ধবী আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসে। একটা রিলেশন, একটা ক্রসওভার কানেকশন তৈরি হয়। কলকাতা থেকে চলে আসার আগের রাত থেকে আমার মন খারাপ শুরু হয়ে যায়। আর কলকাতা এয়ারপোর্টের কাচের দরজাটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি এক বার পিছন ফিরে তাকাই, আর তখনই আমার হঠাৎ করে খুব কান্না পেয়ে যায়।
আমি কেন কাঁদি? আসলে কলকাতা ছাড়ার সময় আমি বুঝতে পারি, কিছু একটা হারিয়ে ফেলছি আমি।
মানুষ কখন কাঁদে? ইনসিকিউরড ফিল করলে! কেন কাঁদে মানুষ? কোনও আনসারটেনিটি থাকলে! আমি কেন কাঁদি? আসলে কলকাতা ছাড়ার সময় আমি বুঝতে পারি, কিছু একটা হারিয়ে ফেলছি আমি। এই যে রিলেশন, এই যে কান্না, এটাই আমার বাঙালিয়ানা।
আমেরিকাতে আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, ‘হোয়ার ইউ ফ্রম’? আমি খুব কম্ফরটেবলি উত্তর দিই, ‘আই অ্যাম ফ্রম কলকাতা’! আমার মায়ের কলকাতা। আমার বাবার কলকাতা। ওরা আমাকে কলকাতার সব গল্প বলে। বাবা মা বলে, ‘মাটির টান’! আমার তখন খুব মায়া হয়। আমার গানে, আমার কবিতায় এই সব স্মৃতি, এই মায়া, ঘুরে ফিরে আসে। ক্রিটিকরা নিশ্চয়ই এটাকেই বাঙালিয়ানা বলবেন। আমার সব কিছুতে নানা কনটেক্সটে এই বাঙালিয়ানা চলে আসে। খুব স্পনটেনিয়াসলি আসে। আর আমি সেটা বেশ এনজয়ও করি।
আরও পড়ুন: বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব না বুঝিয়ে জনগণকে স্বামীজির সরল কথা সরল ভাবেই বোঝানো যেত
আমি ভেবে দেখেছি, আমি যতই গ্লোবালাইজড হই না কেন, আমার মনের গভীরে আমার জন্মভূমিটা থেকেই যায়। ইন্টারন্যাশনালিজম মানেই অবশ্য তাই, ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এখন আমি বেশ বুঝতে পারি যে, বাংলা কালচারটা আমি ভালই অ্যাসিমিলেট করতে পারছি। এই কালচারটা যদি ভিতরে থাকে, তা হলে সময়ে সময়ে সেটা বাইরে বেরিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথকে কোট করি, ‘হীরেটাকে বলি বিদ্যে আর তার থেকে ঠিকরে আসা আলোটাকে বলি কালচার’! কেমন করে আসে, একটা এক্সামপল দিই। আমরা সেবার লাভা লোলেগাঁও গিয়েছিলাম। আকাশ মেঘলা। সেখানে এক্কেবারে টপে উঠেছি যেই, সব মেঘ সরিয়ে হঠাৎ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিল। আর আমার অমনি মনে পড়ে গেল কিছু দিন আগে দেখা একটা বাংলা মুভির গান, ‘মেঘপিওনের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা, মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা’!
সে বার শান্তিনিকেতনে গিয়ে একটা শীতের দুপুরে আমরা কোপাই নদীর ধারে বসে বাউলের গান শুনেছিলাম। একতারার সুর শুনে আমার সেই গানটা মনে পড়েছিল, মা করে খোলা গলায়, ‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’! আমি নিশ্চিত, আমার ভিতরে একটা ইনার ফোর্স আছে, যেটা বন্ধ ঘরের চাবি ভেঙে দিয়ে আমাকে আমার শিকড়ের দিকে নিয়ে যাবে। এই যে ইনার ফোর্স, এটাই আমার বাঙালিয়ানা।
(লেখক আমেরিকায় পাঠরত ও কবি)