সম্পাদকীয় ১

দার্শনিক অবস্থান

একটি অনুশাসন-নির্ভর সমাজে— এবং এমন একটি শাসনকালে, যখন রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে অভিভাবকতন্ত্রের নিগড় আরও কঠোর হইতেছে— এই রায়গুলির তাৎপর্য প্রশ্নাতীত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০৭:০০
Share:

ভারতীয় সমাজ অনুশাসন-নির্ভর। অভিভাবক যাহা বলিয়া দিবেন, যে পথ বাঁধিয়া দিবেন, কার্যত বিনা প্রশ্নে সেই পথে হাঁটাই ভারতীয় সমাজের দস্তুর। সামাজিক পরিসরে একদা সেই অভিভাবকের দায়িত্বটি পালন করিতেন রাজনীতিকরা। ক্রমে সেই শ্রেণির প্রতি ভরসায় টোল পড়িয়াছে, অভিভাবক হিসাবে মানুষ বিচারবিভাগের আশ্রয় চাহিয়াছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলার রায় প্রসঙ্গে বলিল, দেশের সর্বোচ্চ আদালত কোনও সুপার-গার্ডিয়ান বা মহা-অভিভাবক নহে। কথাটির তাৎপর্য অপরিসীম। এক প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে তাঁহার বিবাহবিচ্ছিন্ন পিতার নিকট থাকিতে চাহিয়াছিলেন, তাহাতে আপত্তি করিয়া আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন মা। আদালত জানাইয়াছে, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ইচ্ছায় আদালত হস্তক্ষেপ করিতে পারে না। রায়টি একক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গত এক বৎসরে শীর্ষ আদালত যে রায়গুলি দিয়াছে, তাহার প্রেক্ষিতে এই রায়টিকে দেখিলে গুরুত্ব আরও বাড়ে। কারণ, আদালতের রায়ের মধ্যে একটি দার্শনিক অবস্থান পাঠ করা সম্ভব। ব্যক্তি-মানুষের স্বতন্ত্রতার, স্বায়ত্তের দর্শন। ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তার অধিকার মানিয়া লওয়া হইতে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বে-আইনি ঘোষণা করা, প্রেক্ষাগৃহে জাতীয় সংগীত চলাকালীন উঠিয়া দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক নয় বলিয়া জানাইয়া দেওয়া হইতে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আদালতের হাতে ছয় মাসের বাধ্যতামূলক অপেক্ষার সময়কে কমাইয়া আনিবার অধিকার দেওয়া, রুচি অনুযায়ী খাদ্যের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া— প্রতিটি রায়েই ব্যক্তির স্বতন্ত্রতা এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে মানিয়া লওয়ার দর্শন নিহিত।

Advertisement

একটি অনুশাসন-নির্ভর সমাজে— এবং এমন একটি শাসনকালে, যখন রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে অভিভাবকতন্ত্রের নিগড় আরও কঠোর হইতেছে— এই রায়গুলির তাৎপর্য প্রশ্নাতীত। এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজের জীবন সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিজেই করিতে পারিবেন, এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সেই সিদ্ধান্তকে সম্মান করিতে বাধ্য, ভারতে এই কথাটি স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাহাকে ‘ঠিক’ বলিয়া ভাবে, সেই ছাঁচেই নিজেকে ঢালিয়া লইবার কোনও দায় কোনও ব্যক্তির থাকিতে পারে না। সমাজের চোখে নিজেকে ‘ঠিক’ প্রমাণ করিবার দায়ও কাহারও নাই। ভারতের সংবিধান মানুষকে সেই স্বাধীনতা দিয়াছে। তাহা কাড়িয়া লইবার অধিকার সমাজের বা সরকারের নাই। যতক্ষণ অবধি ব্যক্তির সিদ্ধান্ত সমাজকে কোনও বৃহত্তর ও প্রকৃত ক্ষতির সম্মুখীন না করে, ততক্ষণ অবধি সেই সিদ্ধান্ত মানিয়া লওয়াই বিধেয়। মানিতে কষ্ট হইলে, রুচিতে বাধিলে, সংস্কৃতিতে ঘা লাগিলে অন্য দিকে চোখ ফিরাইয়া রাখা ভাল।

হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিবাহ হইলে অনেকেরই ভাবাবেগে আঘাত লাগে, এবং তাঁহারা ‘লাভ জিহাদ’ রব তুলিয়া ঝাঁপাইয়া প়ড়েন। ব্যক্তিপরিসরের স্বতন্ত্রতাকে স্বীকার করিলে এই প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান লওয়াই বিধেয়। এই প্রেক্ষিতে আদালতের বর্তমান রায়টির কথায় ‘হাদিয়া মামলা’-র প্রসঙ্গ কার্যত অনিবার্য। একটি প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিত হিন্দু মেয়ে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হইয়া যদি কোনও মুসলমান যুবককে বিবাহ করেন, এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তবে কি কোনও ভাবেই সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা চলে? এই বিবাহের বিরোধিতা করিবার অর্থ কি মেয়েটির জীবনের উপর তাঁহার পরিবর্তে পরিবারের অধিকারকেই সর্বোচ্চ মান্যতা দেওয়া নহে? গত এক বৎসরের রায়গুলি হইতে যে দার্শনিক অবস্থানটি পাঠ করা যায়, তাহার সহিত এই বিরোধিতার বৈপরীত্য স্পষ্ট। হাদিয়া মামলায় আদালতের রায় কী হইবে, সেই প্রশ্নটি, অতএব, গুরুতর।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement