বামুন বাড়ির বউ প্রেমে প়ড়িয়া ছকু খানসামার সহিত পলাইয়াছিল। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখনীতে তাহার পরবর্তী আখ্যান আছে। নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার পর ছকু তাহার প্রেয়সীর অধর চুম্বন করিতে যায়। আকাশে তখন চন্দ্রগ্রহণ চলিতেছে। ছকুর প্রেমিকা, বামুন বাড়ির বউ, শশব্যস্ত হইয়া বলে, ‘গ্রহণ লেগেছে, খেতে নেই!’ বামনাই বস্তুটি এমনই দুর্মর। দিল্লির এ কে গোপালন ভবনের তাত্ত্বিক নেতাদের যেমন। লালুপ্রসাদ যাদবের ডাকে পটনার সমাবেশে তাঁহারা শেষ অবধি গেলেন না। কারণ? সেই মঞ্চে কংগ্রেসও থাকিবে। তৃণমূল কংগ্রেসও। তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া যাউক, প্রকাশ কারাটের কেরল লাইন জাত খোয়াইতে রাজি নহে। অতএব, তাঁহাদের বাদ রাখিয়াই সমাবেশ হইল। বিহারের জনতা অভাব বোধ করিলেন, এমন অভিযোগ নাই। তাঁহারা না থাকায় মোদী-বিরোধী রাজনীতির সমীকরণে একটি ফাঁক থাকিয়া গেল, সে কথা ঠিক। কিন্তু, তাহাতে সেই রাজনীতির যতখানি ক্ষতি হইল, সিপিআইএম-এর ক্ষতি তাহার অধিক। কেরলকে বাদ রাখিলে সর্বভারতীয় মঞ্চে সিপিআইএমকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও খুঁজিয়া পাওয়া মুশকিল। সীতারাম ইয়েচুরিরাও জানেন, নিজেদের জোরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকা এখন কল্পনারও অতীত। ফলে, সিপিআইএম-এর সম্মুখে দুইটি পথ ছিল। এক, অন্যান্য ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তির সহিত এক মঞ্চে যোগ দেওয়া; দুই, জাত বাঁচাইবার তা়ড়নায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হইয়া যাওয়া। মাসাধিক কালের ব্যবধানে দল দুই বার দ্বিতীয় পথে হাঁটিল। সীতারাম ইয়েচুরিকে কংগ্রেসের সমর্থনে রাজ্যসভায় না পাঠাইবার সিদ্ধান্তের রেশ মিলাইবার পূর্বেই পটনার মঞ্চ এড়াইয়া দল বুঝাইয়া দিল, মরা ডায়নোসরের দাম ঠিক কত।
দলের কোন পার্টি কংগ্রেসে কী লাইন নির্ধারিত হইয়াছিল, সেই প্রাক্-ইতিহাস এ কে গোপালন ভবনের মনসবদারদের জন্যই থাকুক। যদি একটি নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান হইতে সিপিআইএম-এর কর্তব্য বিচার করা হয়, তবে দেখা যাইবে, নেতারা উদ্দেশ্যর সহিত পন্থার সংঘাত এড়াইতে ব্যর্থ। তাঁহারা ঘোষিত ভাবে নরেন্দ্র মোদী ও নাগপুরের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বিরোধী। কিন্তু, সেই বিরোধিতাকে কার্যকর রূপ দেওয়ার মতো একক শক্তি তাঁহাদের নাই। অতএব, কংগ্রেস আদি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সহিত যৌথ ভাবে লড়াই-এর বিষয়টি তাঁহাদের গুরুত্বসহকারে বিচার করিবার কথা ছিল। বাদ সাধিল কংগ্রেসের শ্রেণিচরিত্র। অবশ্য, শ্রেণিচরিত্র বলিতে প্রকাশ কারাটরা ইদানীং সম্ভবত কেরলের রাজনীতিতে ইউডিএফ ও এলডিএফ-এর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বুঝিতেছেন। কেরলের স্বার্থ রক্ষা করিতে সর্বভারতীয় দলকে তাহার ঘোষিত লক্ষ্য হইতে চ্যুত হইতে হইতেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যখন দলকে ভুল পথে চালনা করে, তখন বিপদসংকেত পড়িয়া লইতে হয়। কিন্তু পড়িবেন কে? ভিন্রাজ্যের নেতাদের তেমন জোর কোথায়?
পার্টি সূত্রে খবর, লালুপ্রসাদ যাদবের মঞ্চ সম্পর্কে সিপিআইএম-এর আর একটি আপত্তি তাহার অনিশ্চয়তায়। বিহারে মহাগঠবন্ধন ভাঙিয়া যাওয়ার পর যে ধর্মনিরপেক্ষ জোটের সম্ভাবনাটি ধাক্কা খাইয়াছে, তাহা সত্য। কিন্তু, একই রকম সত্য এই কথাটি যে রাজনীতি সম্ভাবনারই শিল্প। নীতীশ কুমার জোট ভাঙিয়াছেন বলিয়াই অন্য কোনও জোট অ-সম্ভব, ভাবিবার কারণ নাই। কী ভাবে বিভিন্ন দলের বহুমুখী স্বার্থকে একটি একক উদ্দেশ্যের অভিমুখে চালনা করা যায়, তাহা প্রধানত নির্ভর করে নেতাদের কল্পনাশক্তির উপর। অনিশ্চয়তার অজুহাতটি ব্যবহার না করিয়া বরং সিপিআইএম তাহার বামফ্রন্টের অভিজ্ঞতাটিকে এই মঞ্চে ব্যবহার করিতে পারিত। তবে অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লওয়া একটি বিশেষ গুণ। সকলের সে গুণ থাকে না।