এক ব্যক্তির সম্মুখ দিয়া মরদেহ লইয়া যাইতেছে শববাহকেরা। সহসা তিনি দেখিলেন— দেহটি তাঁহারই কন্যার! শুনিলে অনেক পাঠকের হয়তো মনে পড়িবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অচিন পাখি’ রহস্যকাহিনির কথা। ঘটনাটি ঘটিয়াছে মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা এলাকার বেনিয়াগ্রামে। নিজের পছন্দের পাত্রকে বিবাহ করিবার অপরাধে কন্যার সহিত সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করিয়াছিলেন তপন মণ্ডল। সম্প্রতি কন্যা বাড়ি আসিলেও, সে যে ভাল নাই তাহা বুঝিয়াছিলেন। অতঃপর কন্যার অ্যাসিড পান ও মৃত্যু, পিতা সেই মৃত্যুর সংবাদও পান নাই। কন্যার মরদেহ সেই বার্তা বহন করিয়া আনিল। প্রতি মাসে, প্রতি বছরে কত বিবাহিতা কন্যার মৃত্যুসংবাদ পিতামাতার উপর বজ্রাঘাতের মতো নামিয়া আসে, উদ্ভ্রান্ত হইয়া তাঁহাদের হাসপাতাল ও থানায় ছুটাছুটি করিতে হয়, পুলিশের পরিসংখ্যান হইতে তাহার সামান্যই আভাস মিলিবে, কারণ বধূহত্যার একটি বড় অংশ দুর্ঘটনা কিংবা আত্মহত্যা বলিয়া নথিভুক্ত হয়। তৎসত্ত্বেও বধূর অস্বাভাবিক মৃত্যু, অতঃপর পিতামাতার দ্বারা স্বামী-শ্বশুরবাড়ির নামে হত্যা অথবা আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ— এমন সংবাদের যেন মিছিল চলিয়াছে। জানুয়ারিতে গড়িয়া উত্তর শ্রীরামপুরে উদ্ধার হয় রোমিতা ভট্টাচার্যের (২৬) ঝুলন্ত দেহ। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি উত্তর বন্দর থানার পুলিশ গঙ্গা হইতে উদ্ধার করে সমর্পিতা দত্ত বর্ধনের (৩৩) দেহ। মার্চ মাসে দক্ষিণ শহরতলির নাদিয়াল থানা এলাকার মাঠে শুক্লা কর্মকারের (২০) দগ্ধ দেহ মিলিয়াছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ধারাবাহিকতা রহিয়াছে।
নিরপরাধ মেয়েদের খুন যাহারা করে, তাহাদের যথাযোগ্য শাস্তি অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু নিহত কন্যার পিতামাতার প্রতি সহানুভূতি রাখিয়াও— অন্য একটি প্রশ্ন করিতেই হয়: তাঁহারা কি সন্তানের সুরক্ষায় যথেষ্ট যত্নবান হইয়াছিলেন? সংবাদে বোঝা যায়, বিবাহের পরে নির্যাতনের শুরু, কন্যার পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন, অতঃপর শ্বশুরগৃহে তাহাকে প্রত্যর্পণ, এই চক্রে জীবন ঘুরিতে থাকে। কন্যাকে হারাইবার পরে পিতামাতা আক্ষেপ করেন, নির্যাতন এত দূর বাড়িয়াছিল তাঁহারা বোঝেন নাই। ইহাতে স্পষ্ট, মেয়েরা নির্যাতিতা হইতেছে, সেই সত্যটি তাঁহাদের অবিদিত নহে। তবু ‘মানাইয়া চলিবার’ উপদেশ দিয়াছেন মেয়েকে। বিপর্যস্ত মেয়েটিকে আবার রাখিয়া আসিয়াছেন অত্যাচারী শ্বশুরগৃহে।
অতএব কঠিন প্রশ্নটি না করিলেই নয়। এক দিন কন্যার ভয়ানক পরিণাম ঘটিতে পারে, তাহা কি সত্যই পিতামাতা কল্পনা করেন নাই? মেয়েকে সুস্থ, আনন্দময় জীবন দিতে তাঁহারা কি সত্যই চাহিয়াছিলেন? সত্য ইহাই যে, আজও বহু পিতামাতা ‘কন্যাদায়’ হইতে অব্যাহতি চাহেন। সাধ্যাতীত আড়ম্বর করিয়া এবং পণ দিয়া মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান সারিয়া তাঁহারা ‘দায়মুক্ত’ হন। অতঃপর মেয়ে ও তাঁর সন্তানদের প্রতিপালন করিতে তাঁহারা নারাজ। অবশ্যই, এই পিতামাতাও কুপ্রথার শিকার। কিন্তু মেয়েকে স্বাধীন জীবন হইতে বঞ্চনা করিয়া তাঁহারাও কি সেই প্রথাকে মান্যতা দেন নাই? কন্যার নির্যাতনের মূক সাক্ষী থাকিয়া, তাহার মৃত্যুর পরে শোরগোল তুলিয়া জামাইকে জেলে পাঠাইয়া যাঁহারা ‘কর্তব্য’ সম্পন্ন করেন, সেই পিতামাতাও বধূহত্যার পাপের ভাগী। তাঁহারা এক সামাজিক অন্যায়কে আরও তীব্র করিতেছেন।