প্রভুদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও কণ্ঠস্বর এখনও একেবারে মিলিয়ে যায়নি

আইনের অনাথ সন্তান

আউট-ল পরিচিত শব্দ, কিন্তু অর্থটা আমাদের খেয়াল থাকে না। আউট-ল’র আদত মানে আইনভঙ্গকারী নয়, বা হলেও তাকে আউট-ল বলা হয় উল্টো কারণে।

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

আউট-ল পরিচিত শব্দ, কিন্তু অর্থটা আমাদের খেয়াল থাকে না। আউট-ল’র আদত মানে আইনভঙ্গকারী নয়, বা হলেও তাকে আউট-ল বলা হয় উল্টো কারণে। মধ্যযুগের ইউরোপে অপরাধীদের এ ভাবে সাজা দেওয়া হত। যে হেতু তারা আইন ভেঙেছে, শাস্তিস্বরূপ তাদেরও আইনি সুরক্ষা কেড়ে নেওয়া হত। তাদের সম্পত্তি লুটলে সেটা ডাকাতি বলে গণ্য হত না, বলাৎকার করলে ধর্ষণ নয়, হত্যা করলে খুন নয়; যারা এমন কাজ করত আইনে তাদের সাজা হত না। মধ্যযুগে এমন হাল হত দাগি অপরাধীদের। আমাদের আলোকপ্রাপ্ত গণতন্ত্রে তাবৎ নাগরিককুল আউট-ল, কেতাবে যা-ই লিখুক। শাসককুল আমাদের অধিকার কেড়ে নেয় আক্রোশে নয়, অবহেলা ও অবজ্ঞায়। আর এই বঞ্চিত অরক্ষিত দশা একেবারে বেআব্রু না হওয়া পর্যন্ত আমরাও থাকি পরম নিশ্চিন্তে।

Advertisement

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণে রাষ্ট্রের গঠনে একটা বিশাল সংযুক্তি ঘটেছে, যার নাম প্রশাসন। অতীতের মতো কেবল আইনরক্ষা বা খাজনা আদায় নয়, রাষ্ট্র আমাদের জীবনে বহুগুণ ব্যাপক ভূমিকা পালন করে, সে জন্য আমাদের থেকে দাবি করে প্রচুর, হেঁশেলে শোবার ঘরে উঁকি মারে পর্যন্ত; বিনিময়ে আমাদের প্রচুর প্রতিশ্রুতিও দেয়। এই প্রাপ্যের কতগুলি হল বাস্তব সামগ্রী বা পরিষেবা: রেশনের চাল, রাস্তা-সেতু-পরিবহণ, সন্তানের শিক্ষা, অসুস্থের চিকিৎসা, আপৎকালে ত্রাণ। কতগুলি অদৃশ্য উপকার, যেমন বিদেশি শত্রু বা স্বদেশি দুর্বৃত্তের হাত থেকে রক্ষা, নির্মল পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ সবের মূলে থাকে কিছু নীতি বা অধিকার— চোখে দেখা যায় না, হিসাবে মাপা যায় না, কিন্তু তাতেই আমাদের আসল নাগরিক পরিচয়, তার ভিত্তিতেই অন্য যা কিছু প্রাপ্য।

কার্যত কিন্তু দেখা যায়, বাস্তব প্রাপ্র্যগুলি সম্বন্ধে আমরা যদি বা সজাগ, অদৃশ্য প্রাপ্য ও অধিকার সম্বন্ধে উদাসীন। রেশনে চাল না মিললে শোরগোল ওঠে, চিকিৎসা-বিভ্রাটের অভিযোগে হাসপাতাল ভাঙচুর হয়। কিন্তু যেখানে হাতে হাতে সরাসরি কিছু পাওয়ার নেই, লাভটা অদৃশ্য বা সুদূরমেয়াদি, তার অভাব অনেক গুরুতর হলেও আমাদের টনক নড়ে না, প্রতিবাদের কথা মনেই আসে না। ফলে শাসকগোষ্ঠীও নিশ্চিন্ত— নেতাদের ভোট বিপন্ন হয় না, অতএব আমলাদের কানমলা খেতে হয় না। এ ভাবে সেই উপকার বা অধিকারটুকু অজান্তে আমাদের জীবন থেকে বেমালুম উবে যায়।

Advertisement

একটা মর্মান্তিক উদাহরণ দিই। কিছু দিন যাবৎ কলকাতার বাতাস মারাত্মক ভাবে, অভূতপূর্ব ভাবে বিষাক্ত— নগরবাসী মাত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত, শিশুরা সর্বাধিক। অনেকের আয়ু কমবে, আরও অনেকে জীবদ্দশায় রোগক্লিষ্ট হচ্ছে ও হবে— চিকিৎসকদের দ্বিমত নেই। রাজ্য সরকারের পরিবেশ দফতর আছে, পুরসভা আছে, আছে খাতা-কলমে স্বাধীন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। সর্বোপরি, রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনের সরব সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। এই কালান্তক অবস্থা নিয়ে এদের কারও টুঁ শব্দ শোনা যায়নি, তারা আদৌ অবগত কি না বোঝার উপায় নেই। অর্থাৎ পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও প্রশাসনের এত যে সমারোহ, তার ছত্রচ্ছায়া থেকে আমরা নির্বাসিত, পরিবেশের ক্ষেত্রে আউট-ল। আর, কিছু বেরসিক পরিবেশবিদ যতই গলা ফাটাক, হেলদোল নেই আমাদেরও। সিগারেটের মোড়কে লেখা থাকে, ‘ধূমপান মৃত্যুর কারণ’। সাম্প্রতিক হিসাব, প্রত্যেক কলকাতাবাসী দিনে বাইশটা সিগারেটের সমান দূষণের শিকার। ডেঙ্গি ও ‘অজানা জ্বর’ যতই ভীতিপ্রদ হোক, তুলনায় তুচ্ছ; কিন্তু যে হেতু সেখানে মৃত্যু ঘটছে চোখের সামনে, আমরাও খানিক সজাগ, কর্তৃপক্ষও কিছু নড়াচড়া করছেন। আজকের একটি শিশুর দূষণজনিত মৃত্যু ঘটতে অনেকগুলি নির্বাচন কেটে যাবে, তাই শাসকের পরোয়া না-ই থাকতে পারে। কিন্তু আমরা?

ব্যাপক শিক্ষিত সমাজ যেখানে এই মারণ বিপদ সম্বন্ধে নির্বিকার, অন্যান্য অশেষ ক্ষেত্রে আমরা যে ন্যায়নীতির আশ্রয়চ্যুত— সেটা ভুলে থাকাই স্বাভাবিক। রোগী-মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতালে আকছার হামলা হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভাবে যে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আরও বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে, বহু রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেটা আমরা জানতেই পারি না, জানলেও তেমন বিচলিত হই না, কারণ সেই রোগীরা চোখের সামনে মরছে না। সে দিনই পড়লাম, তিনটি বহুমূল্য জীবনদায়ী যন্ত্র দেড় বছর অব্যবহৃত বা অল্পব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। সংশ্লিষ্ট আধিকারিক বলেছেন, এ সব গুরুতর ব্যাপারে একটু সময় লাগে। গুরুতর কাজ জরুরি ভিত্তিতে করার যুক্তিটা এখানে অবশ্যই অচল। একটা রাস্তা বা সেতু তৈরি হতে কত দিন লাগবে, তার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ্যে টাঙানো থাকে। ‘হাসপাতালে অমুক যন্ত্র এসেছে, অমুক তারিখে চালু হবে’, এমন বিজ্ঞপ্তি কল্পনাতীত, কারণ তা হলে উচ্চতর কর্তারা দায়বদ্ধতায় জড়াবেন।

যেখানে নাগরিক কোনও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত, পরিষেবায় দেরি বা ঘাটতি হচ্ছে, সেখানে তো বটেই; উপরন্তু যেখানেই প্রশাসন চলছে নাগরিককে অন্ধকারে রেখে তোয়াক্কা না করে, দায়বদ্ধতা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা অস্বীকার করে, তেমন প্রত্যেকটা নজির যখন ঘটছে যেটুকু ঘটছে সেই মাত্রায় আমাদের নাগরিক সুরক্ষা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, আমরা হয়ে পড়ছি আউট-ল। পাঠক ভেবে দেখুন, তাঁর জীবনে এমন ছোটবড় কত ঘটনা ঘটেছে ও ঘটে চলেছে, মধ্যরাতে মাইক থেকে শুরু করে প্রাপ্য টাকা পেতে হয়রানি, হাসপাতালে ভর্তি নাকচ, শংসাপত্র পাওয়া থেকে শিক্ষায়তনে ভর্তি অবধি কোথাও-না-কোথাও উৎকোচ-দান বা পার্টি অফিসে ধর্না, হয়তো বা দুটোই। আর এক ধাপ এগিয়ে ভাবুন, আপনার পরিচিত মহলে কত লোকের জীবনে এমন কত কী ঘটছে— সংবাদমাধ্যমের খবর ছেড়েই দিলাম। তার পর হিসাব করুন, নাগরিক জীবনের ঝড়ঝাপ্টা সামলাতে আইন-বিধি-ন্যায়নীতি-প্রশাসনের ছাতাটা কতটুকু কার্যকর।

বেশি রং চড়ানো উচিত নয়। মানতে হবে, আমাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে ঘাটতির মাত্রা দুঃসহ নয়। মোটের উপর ঘাড় গুঁজে নির্বিঘ্নে আমরা বসবাস করছি। খামকা নালিশের জিগির তুলে শান্ত জীবন অশান্ত করব কেন? করতে কেউই চাই না, কিন্তু একটু যেন খেয়াল থাকে, আড়ালে অদৃশ্য দানব হানা দিচ্ছে কি না। সন্তানের মুখে প্রাণপণে পুষ্টি ঠাসছি, এ দিকে তার নাক দিয়ে দিবারাত্র বিষ ঢুকছে। ট্রাফিক পুলিশ আর গাড়ির চালক পরস্পরকে শাপান্ত করছি, উচ্চতর অনাচারে দু’জনেরই আয়ুক্ষয় হচ্ছে, সে হুঁশ নেই। দূষণের উদাহরণটা কেবল আক্ষরিক অর্থে নয়, আমাদের নাগরিক জীবনের উপমা বা রূপক হিসাবেও ভাবুন।

সমস্যা কেবল আদালতগ্রাহ্য আইন নিয়ে নয়, বরং অনেক বেশি মাত্রায় সাধারণ ন্যায়বোধ ও সুস্থ নীতি নিয়ে, প্রশাসনযন্ত্রের দৈনন্দিন পরিচালনার স্তরে। এক আধিকারিককে বলতে শুনেছি, ‘‘আইনে কোথাও লেখা নেই, কত দিনে চিঠির জবাব দিতে হবে।’’ সত্যিই তো, আইনে অনেক কিছু লেখা থাকে না, ছেড়ে দেওয়া হয় বিবেচনা ও শুভবুদ্ধির উপর। সেটার অভাব ঘটলে আইনের রক্ষাকবচটুকু জোটে না— ল-ই নেই তো আউট-ল কিসের?

এই যুক্তির একটা প্রয়োগ প্রশাসক মহলে প্রায়ই শোনা যায়। অটো থেকে চোলাই মদ, অসংখ্য ক্ষেত্রে লোকে দিব্যি ঘুরছে-ফিরছে করে খাচ্ছে কোনও ছাড়পত্র বিনা; আইনের রক্ষকরা বলছেন, ‘‘আমাদের খাতায় তো এদের অস্তিত্বই নেই, ধরি কী করে?’’ অকাট্য যুক্তি। যে আইনভীরু ব্যক্তি নিয়ম মেনে কাজ করেন, পান থেকে চুন খসলে কর্তারা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন; যে মানুষ সব আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে আইনের নাগালের বাইরে। এই প্রশাসনিক তঞ্চকতার আর এক প্রকাশ: ‘‘অভিযোগ না এলে কী করি বলুন?’’ যিনি বলছেন তাঁর দায়িত্ব তথা অধিকার নিজে থেকে খোঁজ রাখা ও ব্যবস্থা করা। তবু অভিযোগ যদি না আসে (হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ভয় পাচ্ছে বলে; হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত কেউ নেই, সবাই অনাচার থেকে লাভবান হচ্ছে বলে) আইন থাকবে শিকেয় তোলা।

আউট-ল তত্ত্বের এই অন্য প্রয়োগে বিস্ময়ের কিছু নেই। নাগরিক জীবন থেকে আইনের অপসারণ ঘটলে শিষ্টের বঞ্চনার পাশাপাশি দুষ্টের পালন অবধারিত। এ ভাবে কিছু ভাগ্যবান দুষ্কৃতী আইনের আওতার বাইরে থেকেই নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা ভোগ করে, আর সবার দৃষ্টিগোচর হলেও পুলিশের চোখে তারা ফেরার। আবার একই তত্ত্বের বিপরীত প্রয়োগে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র স্বগৃহে বসবাস করে, কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত উপস্থিত থেকে, মায় ক্যামেরার আলোয় রাষ্ট্রপতি ভবন ঘুরে এলেও ফেরার হওয়ার দায়ে তাঁর নামে পরোয়ানা জারি হয়।

পাঠককে দোহাই, আমার নালিশ কোনও বিশেষ রাজ্য বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখ অনেকটাই রাজ্য স্তরে, তাই সে কথা আগে মনে হয়। আরও দূরে তাকালে চিন্তা বাড়বে বই কমবে না। গোবলয়ের অবস্থা বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্যান্য রাজ্যের খবরও আশাব্যঞ্জক নয়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে, আমাদের আইনবঞ্চিত অবস্থার একটা বিশেষ রকমফের কেবল জাতীয় স্তরেই ঘটা সম্ভব, যদিও রাজ্যগুলি দরকার মতো তা নির্দ্বিধায় কাজে লাগায়— সেটা হল, আইনের বঞ্চনাকেই আইনি স্বীকৃতি দেওয়া।

আমরা জানি, ব্রিটিশ আমলের রাজদ্রোহী-দমনের আইনগুলি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে বিভিন্ন অবতারে আজও বিদ্যমান। সংবিধানস্বীকৃত নাগরিক অধিকারগুলি এই সব আইনবলে মুলতুবি রাখা চলে। কোনও আইনে ব্যক্তিবিশেষকে আটক রাখতে রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। অপর কোনও আইনে এক গোটা রাজ্যে সেনাবাহিনীর কোনও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকারের অধিকার ব্যাহত হচ্ছে। এই আইনগুলির প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ আমার আলোচনার বিষয় নয়; শুধু এটুকু বলা উদ্দেশ্য যে, এর ফলে একক ভাবে তো বটেই, রাজ্য জুড়ে নাগরিক সত্তা কার্যত ‘আউট-ল’ড’ হয়ে পড়ছে বিশেষ অ-সাধারণ আইনবলে, যা আমাদের সাধারণ আইনসিদ্ধ নাগরিক পরিচিতির পরিপন্থী। ফলে আমাদের মনে এই ধারণাটা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে ওই নাগরিক সত্তা অমোঘ কিছু নয়, অন্য যে কোনও আইন দিয়ে তা খর্ব করা যায়।

এক বার এই ধারণাটা চালু করতে পারলে অন্য নানা আইন পাশ করে সাধারণ নাগরিককে বশে আনা যায়; আর কেবল পুরোদস্তুর আইন নয়, যে কোনও সরকারি নিয়ম-নির্দেশ, বা কোনও বিশেষ আধিকারিকের খামখেয়ালেও নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যায়। যে ধরনের খুচরো স্বৈরাচার আমরা থানার দারোগার আচরণে দেখে অভ্যস্ত, সারা দেশে কেন্দ্রীয় স্তরে তার দাপট ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

এ ভাবেই আমাদের জনজীবন সংক্রামিত হয়েছে একটার পর একটা ব্যবস্থায় যেখানে কর্তৃপক্ষের কোনও আলটপকা ফরমানে— তা সে অদরকারি হোক, অযৌক্তিক হোক, অকার্যকর হোক— আমরা কোনও প্রাপ্য বা অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারি। স্থানাভাবে একটা উদাহরণই যথেষ্ট। দেশসুদ্ধ মানুষকে বাজি রেখে কেন্দ্রীয় সরকার আধার কার্ড নামে যে বিশাল কম্পিউটার গেমে মেতেছেন, তার শর্ত মেটাতে না পেরে (যে কোনও খেলার শর্তই অল্পবিস্তর খেয়ালি, অবাস্তব) কিছু মানুষ না খেয়ে মরেছে, আরও বেশি লোক শিক্ষা বা চিকিৎসা পায়নি, বা প্রাপ্য টাকা পায়নি এমনকী নিজের টাকার উপর দাবি খুইয়েছে। সব কিছুই হয়েছে আইনবলে, এমন আইন, যাতে প্রতিকার চাইবার, এমনকী জালিয়াতি হলে পুলিশে যাওয়ার অধিকারও আমাদের নেই, কারণ আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যের উপর আমাদের আর দখল থাকছে না। এমন ব্যবস্থাকে আমরা স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন ও নিরাপত্তার পরিপন্থী বলে ভাবতে পারি। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশে কয়েকটি বিশেষ ধারায় কিছুটা রাশ টানা হয়েছে, মৌলিক অবস্থান পাল্টেছে কি না তা আজও বিতর্কের বিষয়।

শেষ একটা কথা। সাধারণ নাগরিকের সম্মান ও অধিকার রক্ষার জন্য গত কয়েক দশকে জাতীয় ও রাজ্য স্তরে কিছু স্বাধীন সংস্থা স্থাপিত হয়েছে। এদের অধিকাংশের আইনি ক্ষমতা না থাকলেও সাংবিধানিক গুরুত্ব ও মর্যাদা যথেষ্ট। সর্বাগ্রে অবশ্যই খোদ মানবাধিকার কমিশন, তা ছাড়া নারী, শিশু ও বিভিন্ন বঞ্চিত গোষ্ঠী সংক্রান্ত কমিশন, তথ্য-অধিকার কমিশন, উপভোক্তা আদালত প্রভৃতি। কিছু দিন যাবৎ স্পষ্ট হচ্ছে, ছোট মানুষের বাড় বাড়ানো এই সংস্থাগুলির ডানা ছাঁটতে দলনির্বিশেষে সরকারমাত্রেই মরিয়া। যে হেতু সরকারই তাদের সদস্য নিয়োগ করে, পছন্দসই লোক বসিয়ে বা আদৌ কাউকে না বসিয়ে অনেকটা কাজ হাসিল করা যায়, আইনবলে সংস্থাগুলির চরিত্র ও কার্যপদ্ধতি পাল্টানো যায়। এ রাজ্যে মানবাধিকার কমিশনের একদা উজ্জ্বল উপস্থিতি আজ নিষ্প্রভ। তথ্য-অধিকার আইনের বিরুদ্ধে দেশভর আমলাকুল এককাট্টা, সে জন্য অজুহাতের অভাব নেই। সঙ্গে নতুন সংযোজন, সরকার থেকেই বিরোধিতা করে মামলা রুজু। কমিশনের সদ্য-অবসরপ্রাপ্ত সদস্য শ্রীধর আচারিয়ুলু বলেছেন এ সব মামলার উদ্দেশ্য স্রেফ বাধাসৃষ্টি ও হেনস্থা করা। নাগরিকের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা যে এমন উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রমাগত করা হয় তা বলা বাহুল্য।

ভারতীয় সংবিধান বিশ্বশ্রেষ্ঠের একটি। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত রাখতে বিধানের ত্রুটি নেই। এমন প্রতিকূল অবস্থায় দেশের শক্তিশালী গোষ্ঠী কষে ভাবছে, এই সুরক্ষা থেকে নাগরিকদের কী করে বঞ্চিত করা যায়, কী করে দেশের লোককে আইনের অনাথ বানিয়ে ক্ষমতা চরিতার্থ করা যায়। কখনও নীরবে লুকিয়ে-চুরিয়ে, কখনও বুক ফুলিয়ে হামলা করে, কখনও আইনকেই কাজে লাগিয়ে। সাধারণ নাগরিক অতএব নিজভূমে পরবাসী, সাংবিধানিক বলে বলীয়ান হয়েও অসহায়।

অসহায় মানুষ কী-ই বা করতে পারে? আমাদের নখ নেই দাঁত নেই, প্রভুদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও নেহাত গলার স্বর এখনও একেবারে মিলিয়ে যায়নি। যত দিন সম্ভব সেটার সদ্ব্যবহার করেই বাঁচা যাক। কণ্ঠরোধ করা আর টুঁটি চেপে ধরার মধ্যে কিন্তু বিশেষ ফারাক নেই। গোড়া থেকে যদি নীরব থাকি, নিজের অজান্তে কবে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে, আমরা টেরও পাব না।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।​

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement