নেহাত পাটিগণিতের নিয়মেই জাপান এবং জার্মানিকে অর্থব্যবস্থার আয়তনে টপকে যাবে ভারত। অর্থব্যবস্থার পরিচালকরা তার কৃতিত্ব দাবি করলে মুশকিল— বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ হওয়ার সুবাদে অত্যন্ত কম মাথাপিছু আয় সত্ত্বেও ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এখন বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম। জিডিপির অঙ্কে ভারত যদি জাপান ও জার্মানিকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানে উঠে আসে, তাতেই বা কী? ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার যে স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশবাসীকে দেখাচ্ছেন, তা কি আদৌ সত্য হতে পারে? রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর, অর্থশাস্ত্রী রঘুরাম রাজন তাতে সংশয় প্রকাশ করেছেন। সেই সংশয়ের মূলে রয়েছে একটি সাধারণ হিসাব। ভারতে এখন মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বছরে ২৭০০ ডলারের কাছাকাছি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুসারে, উন্নত দেশ হিসাবে গণ্য হতে গেলে মাথাপিছু আয় অন্তত ১৪,০০০ ডলার হতে হবে। আজকের হিসাবটিই বজায় থাকলে আগামী ২২ বছরে ভারতকে মাথাপিছু আয় ২৭০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৪,০০০ ডলারে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ, মাথাপিছু আয় বছরে ৭.৭ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। তার পাশাপাশি যদি জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বার্ষিক ০.৭ শতাংশ ধরা হয় (এখন আনুমানিক যে হারে ভারতের জনসংখ্যা বাড়ছে), তা হলে জিডিপি বৃদ্ধির বার্ষিক হার হতে হয় প্রায় সাড়ে আট শতাংশ। আজ অবধি টানা দু’দশকের বেশি সময় ধরে বছরে ৮.৫ শতাংশ হারে কোনও অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধি ঘটেনি, এমনকি চিনেরও নয়। নরেন্দ্র মোদীর শাসনের দশ বছরে দেশের গড় আর্থিক বৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের সীমা ছাড়ায়নি। ফলে, ভারত হঠাৎ আজ থেকেই কোমর বেঁধে বছরে সাড়ে আট শতাংশ বৃদ্ধির বেগে দৌড়বে, আশা করা খুবই কঠিন।
বছরে সাড়ে আট শতাংশ হারে বৃদ্ধি আদৌ সম্ভব কি না, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী কি আদৌ কথাগুলি ভেবে বলেছেন? দু’-একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। ২০১৭ সালে তিনি বলেছিলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে ২০২২ সালে, তার পর কেটে গিয়েছে আরও দু’বছর— প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেননি। তার সহজ কারণ— পাঁচ বছরে আয় দ্বিগুণ করতে গেলে বছরে বৃদ্ধির হার প্রায় ১৫% হওয়া প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রে সে হারে বৃদ্ধি কখনও হয়নি। বর্তমান জমানার কৃষিনীতিতে তা আরম্ভ অসম্ভব। ২০১৯ সালের প্রতিশ্রুতি— পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার আয়তনের অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠা— এই গোত্রের আর একটি উদাহরণ। তার জন্য টানা পাঁচ বছর গড়ে পৌনে এগারো শতাংশ হারে বৃদ্ধি প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে কোভিড এসে প্রধানমন্ত্রীর মুখরক্ষা করেছে— নচেৎ, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সেরা সময় মনমোহন সিংহের জমানাতেই যে হারে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেনি, এই জমানায় তার কথা ভাবাও অবাস্তব।
অনুমান করা চলে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সকলই ‘জুমলা’— তিনি জানেন, ‘দ্বিগুণ করে দেব’, ‘তিন গুণ করে দেব’, ‘উন্নত দেশ হয়ে উঠব’ এই সব কথায় মানুষ হাততালি দিতে ভালবাসে। এমনিতেই মানুষ সংখ্যার হিসাব মিলিয়ে দেখে না, তার উপরে আবার যে প্রতিশ্রুতি দু’দশকেরও বেশি সময় পরে ফলবে, তার হিসাব! কাজেই, অর্থব্যবস্থার প্রকৃত উন্নতির জন্য যা করণীয়, সে কাজগুলির দিকে মন না দিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সস্তায় পুষ্টিকর। ভারতে বাহ্যিক পরিকাঠামো খাতে যদিও বা খানিক উন্নতি হচ্ছে, মানবিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে অবহেলা প্রকট। শিক্ষাক্ষেত্রের চেহারা প্রতি দিন করুণতর হচ্ছে। একুশ শতকের জ্ঞান-অর্থনীতিতে যোগ দেওয়ার মতো মানবসম্পদ নির্মাণ না হলে উন্নত দেশ হয়ে ওঠার গল্পটি যে নিষ্ঠুর রসিকতামাত্র, সাধারণ মানুষের এ বার এই কথাটি বোঝা প্রয়োজন।