নবান্ন। ফাইল চিত্র।
অতঃপর, লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পেলেও ষাট অনূর্ধ্ব বিধবা মহিলাদের বিধবা ভাতা পেতে সমস্যা হবে না। বিরোধীরা সমস্বরে বলেছেন, পঞ্চায়েত ভোট সমাসন্ন, সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নির্বাচনী গণতন্ত্রে ভোটের সঙ্গে সরকারের নীতির যোগ অবিচ্ছেদ্য। সেই চালুনিতে ছাঁকতে গেলে অতএব মুশকিল— তখন কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, গুজরাতে ভোট এসেছে বলেই তো প্রধানমন্ত্রীও রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তরে ঘুরে প্রকল্প উদ্বোধন করছেন, সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন? অতএব, বিধবা ভাতার প্রশ্নটিকে নির্বাচনী রাজনীতির মাপকাঠিতে বিচার করে লাভ নেই— তা নির্বাচনমুখীই, এবং ‘স্বাভাবিক’ ভাবেই তাই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি গভীরতর প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন। নির্বাচনমুখী সিদ্ধান্তের চরিত্র কী? তা কোন জনগোষ্ঠীর পক্ষে, কী ভাবে লাভজনক হতে পারে? বিধবা ভাতা যে অতি দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি প্রকল্প, তাতে সংশয়ের অবকাশ নেই। নির্বাচনী রাজনীতি যদি তাঁদের পক্ষে লাভজনক কোনও নীতির পথ খুলতে পারে, তা হলে শুধুমাত্র নির্বাচনের কথা বলে তার বিরোধিতা করার মধ্যে সঙ্কীর্ণতা রয়েছে। আপত্তির অন্য ক্ষেত্র রয়েছে— রাজ্যের আর্থিক অবস্থা, যে প্রসঙ্গে খানিক পরে প্রবেশ করা যাবে।
প্রশ্ন হল, একই সঙ্গে লক্ষ্মীর ভান্ডার ও বিধবা ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি কি নৈতিক ভাবে যথাযথ? বিধবা ভাতার ক্ষেত্রে নিয়ম হল, যাঁদের বার্ষিক আয় বারো হাজার টাকার কম, অর্থাৎ মাসিক আয় এক হাজার টাকার কম, একমাত্র তাঁরাই এই ভাতা পাবেন। লক্ষ্মীর ভান্ডারে মাসিক প্রাপ্তির পরিমাণ এক হাজার টাকা। ফলে, যাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পাচ্ছিলেন, তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই বিধবা ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা হারাচ্ছিলেন। রাজ্য সরকার এই জটটিই খুলে দিল। কেউ আপত্তি করতে পারেন যে, অন্যরা যেখানে একটি প্রকল্পের থেকে আর্থিক সহায়তা পাবেন, বিধবাদের ক্ষেত্রে দু’টি সহায়তা দেওয়া হলে তা কি অন্যদের প্রতি অন্যায্যতা নয়? এ ক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, দু’টি ভাতার দার্শনিক অবস্থান এক নয়। লক্ষ্মীর ভান্ডার মহিলাদের হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে তাঁদের আর্থিক ক্ষমতায়নের চেষ্টা; স্বামীর মৃত্যুতে সচরাচর যে প্রবল আর্থিক অনটন তৈরি হয়, বিধবা ভাতা তার থেকে উদ্ধারের চেষ্টা। ফলে, যাঁরা বিধবা ভাতা পান, তাঁদের ক্ষেত্রে এই টাকাটি এক গোত্রের সামাজিক ক্ষতিপূরণ। দুই প্রকল্পের মধ্যে সংঘাত নেই, ফলে এই আপত্তিটিকে অগ্রাহ্য করা চলে।
কিন্তু বৃহত্তর আপত্তি হল আর্থিক প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গের রাজকোষের যে অবস্থা, তাতে কি সরকারের পক্ষে দু’হাতে টাকা বিলিয়ে চলা সম্ভব? লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের জন্যই রাজ্য সরকারের বছরে তেরো হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ হয়। ঘটনা হল, ষাট অনূর্ধ্ব বিধবাদের ভাতা দিতে যত টাকা খরচ হবে, তা লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দের তুলনায় সামান্যই। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। যদি সরকার বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে এই প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের নীতিটি চালিয়ে যেতে চায়— উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক ভূমিকার কথা স্মরণ করা বিধেয়— তা হলে সরকারকে অর্থোপার্জনের দিকে মন দিতে হবে। রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ না বাড়িয়ে কেবল টাকা বিলিয়ে গেলে হিসাব না মেলারই কথা।