ধর্ষণে অভিযুক্তের পক্ষে শাসক দলের মিছিল, এই দৃশ্য কি তবে প্রচলনসিদ্ধ হয়ে গেল? যে যে রাজ্যে এ চেনা ছবি, সেই তালিকায় অন্তত পশ্চিমবঙ্গ থাকবে না, এই বাঙালি অস্মিতাও চুরমার হল? পশ্চিম মেদিনীপুরে দলীয় কার্যালয়ে ডেকে এক মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের এক অঞ্চল সভাপতির বিরুদ্ধে। এহ বাহ্য, আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেও অভিযুক্তকে দেখা যাচ্ছে এলাকাতেই, তাঁর সমর্থনে মিছিল করছেন তৃণমূল বিধায়ক। বাকি ঘটনাপরম্পরাও বহুদৃষ্ট: নির্যাতিতাকে নিজেদের ‘সক্রিয় কর্মী’ ঘোষণায় বিরোধী দলের বিক্ষোভ, শাসক দলের তরফে নেতাকে ‘ফাঁসানো’র পাল্টা অভিযোগ, পুলিশের চিরাচরিত বিবৃতি— অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেলে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হবে। শাসক ও বিরোধী দল, পুলিশ, নির্যাতিতার স্বাস্থ্য রিপোর্ট নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় হাসপাতালের লোফালুফি— এই সব কিছুর মধ্যে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে আসল সত্য: এক নারীর চরম নিগ্রহ, তাও আবার শাসক দলের কার্যালয়ের ভিতরে। প্রশাসন কতটা অধঃপাতে গেলে এমন ঘটনা ঘটে, ভেবেও শিউরে উঠতে হয়।
সরকার যখন দলের ভাষায় কথা বলে, শাসনদণ্ডটি নামিয়ে রেখে দলেরই পতাকা তুলে ধরে, তখন এই অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী। ভারতের নানা রাজ্যের মতোই, সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গেও বার বার এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে: কোনও অপরাধের অভিযোগ উঠলে সরকারের তৎক্ষণাৎ যে পদক্ষেপ করার কথা, সেই পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে শাসক দলের স্বার্থ। সরকারি অফিসে কোনও কর্মীর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত তো পরের কথা, অবিলম্বে তাঁকে নিলম্বিত বা ‘ক্লোজ়’ করা হয়। অথচ এক জন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো অভিযোগ এলে শুধু তাঁর দলই নয়, ঢাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে খোদ সরকারই। মেদিনীপুরের ঘটনাতেও তা-ই দেখা যাচ্ছে— সরকারের আজ্ঞাধীন পুলিশ গড়িমসি করছে গ্রেফতারিতে, শাসক দলের তরফে সামান্য রিপোর্ট চাওয়ার বেশি এমন কোনও পদক্ষেপ এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি যাতে এই বার্তাটি সমাজে সকলের কাছে পৌঁছয় যে অভিযুক্ত যতই প্রভাবশালী বা জনপ্রিয় নেতা হোন, জঘন্য অপরাধে ছাড় পাবেন না। সরকারের কাজ ‘রাজধর্ম’ পালন করা, দলের ধর্ম নয়— পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল সরকার যে এই সত্যটি বিস্মৃত হয়েছে, প্রমাণ আর জি কর থেকে শুরু করে হালের মেদিনীপুর কাণ্ডেও তার তাৎক্ষণিক নিষ্ক্রিয়তা, অভিযুক্তকেই আড়াল করার মনোভাব। অথচ বিধানসভায় ‘অপরাজিতা বিল’ এনে রাজ্য সরকার বলেছিল, এই বিলের মূল কথাই হল কঠোর শাস্তি, দ্রুত তদন্ত, দ্রুত ন্যায়বিচার; ধর্ষণ রুখতে দেশকে পথ দেখাবে বাংলা-ই। এই কি সেই পথনির্দেশের নমুনা? আর আছে ভারতের অন্য রাজ্যে কোথায় কী পরিমাণ নারীনিগ্রহ হচ্ছে সেই কুমিরছানা তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গকে নিরাপদতম বলে প্রতিষ্ঠার ফিকির, তৃণমূল নেতারা যে কাজে সিদ্ধিলাভ করেছেন।
তৃণমূলে দল ও সরকারের অবিসংবাদিত মুখ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও কি ইতিকর্তব্য নয়, এই ঘটনায় অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের? কেবল দলীয় সুপ্রিমো হিসাবে দলের শুদ্ধির জন্যই নয়, এই মুহূর্তে দেশের মাত্র দু’জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর এক জন বলেই নয়, নারীনিগ্রহের এমন অভিযোগে কঠোর প্রশাসক রূপে তাঁর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। প্রশাসনের কঠোর হওয়ার শক্তি জোগায় সংবেদী মন, দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক অবস্থান থেকে যা নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ায়। সেই মানবিক মূর্তি ও ভাবমূর্তি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে নানা সময়ে, ধর্ষণ ও নারীনিগ্রহের নানা অভিযোগকে ‘ছোট ঘটনা’, ‘সাজানো ঘটনা’ বলে দাগিয়ে বা উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতায়। সরকার নয়, দলই তাঁর কাছে সর্বৈব প্রশ্রয়ের, এমনকি দলের ভিতরের অপরাধও, এ অতি দুর্ভাগ্যের।