ফাইল চিত্র।
উনিশ শতকের কবি কলকাতায় রাতে মশা দিনে মাছির সঙ্গে সহ-বাস নিয়ে খেদোক্তি করেছিলেন। দু’শো বছর পরেও যে কলকাতায় অবস্থার ‘উন্নতি’ হয়নি, বিশেষত মশার সঙ্গে ঘরবসতির ক্ষেত্রে, তার প্রমাণ শহর ও রাজ্যের ডেঙ্গি পরিস্থিতি। বঙ্গে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছুঁয়েছে, গত তিন সপ্তাহেই আক্রান্ত ৫ হাজারেরও বেশি। কলকাতায় গত জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত সাড়ে আটশোরও বেশি ডেঙ্গি আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে, তার অর্ধেকই পুরসভার ২৪টি ওয়ার্ডে; ১০৬, ১১২ ও খোদ মেয়র যেখানে কাউন্সিলর সেই ৮২ নং ওয়ার্ড ডেঙ্গি-আক্রান্ত তালিকায় উপরের দিকে। কোথাও পরিস্থিতি খানিক নিয়ন্ত্রণে আসছে তো বেড়ে যাচ্ছে অন্য বহু ওয়ার্ডে। মৃত্যু হয়েছে কয়েক জনের। দুর্গাপূজা এগিয়ে আসার মুখে নাগরিক-মৃত্যু ও অসুখ উৎসবের আনন্দ-আবহকে আচ্ছন্ন করছে।
ডেঙ্গির এই প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। প্রতি বছর এই সময় সে শহর ও রাজ্য দাপায়, প্রাণ কাড়ে— প্রতি বছর ডেঙ্গির খবর সংবাদপত্র জুড়ে থাকে। এবং প্রতি বছরই নিয়ম করে একই কথা ফিরে বলতে হয়: ডেঙ্গির মোকাবিলায় পুরসভা ও স্বাস্থ্য দফতর কী কী করছে, কতটা করছে, ঠিকমতো ও ঠিক সময়ে করছে কি না। এ বছর পুরসভার কিছু পদক্ষেপ আলাদা করে চোখে পড়ছে— অত্যধিক ডেঙ্গি আক্রান্ত ওয়ার্ডগুলিতে বিশেষ ‘ফিভার ক্যাম্প’ বসানো, জনবসতির মধ্যে খালি পড়ে থাকা প্লটগুলিকে পরিষ্কার করা, বাজারে ও পাড়ায় ‘মাইকিং’-এর মাধ্যমে ডেঙ্গি সম্পর্কে প্রচার ইত্যাদি। কিন্তু এই সবও কি ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্তের জন্যই নয়? এখন আক্রান্তের সংখ্যা মাত্রা ছাড়ানোয়, নাগরিক-মৃত্যুর ঘটনায় এই তোড়জোড়, ভাবলে ভুল হবে কি? বর্ষার মরসুম শুরুর আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা— জলাশয় ও যে-যে জায়গায় জল জমতে পারে, পূর্বানুমানে সেগুলি পরিষ্কার করার বন্দোবস্ত করা, জনবসতি জঞ্জালমুক্ত রাখা ও সর্বোপরি ডেঙ্গি, তার উপসর্গ ও চিকিৎসা নিয়ে তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রচার অভিযান— কি প্রয়োজন ছিল না? বাগবাজারের যে মহিলা ডেঙ্গিতে মারা গেলেন তিনি থাকতেন মাঠে ত্রিপল-টাঙানো অস্থায়ী ঘরে, গত বছর আগুনে বস্তি পুড়ে যাওয়ার পরে অদ্যাবধি সংশ্লিষ্ট দফতর তাঁকে একটি স্থায়ী ঘর বানিয়ে দিতে পারেনি। হরিদেবপুরে ডেঙ্গিতে মারা যাওয়া মহিলার প্রতিবেশীরা অভিযোগ করেছেন এলাকা অপরিষ্কার থাকার, যত্রতত্র জল জমে থাকার কথা। প্রতি বছর একই অভিযোগ, একই অবহেলা, এ-ই কি কলকাতার ভবিতব্য?
ভুল পুনরাবৃত্ত হলে তা আর ভুল নয়, মূর্খামি— প্রবাদবাক্য। কর্তৃপক্ষের মূর্খতা নাগরিক-দুর্ভোগ ও জীবনহানির কারণ হলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই নয়। কিন্তু ডেঙ্গি প্রতিরোধে সবই কর্তৃপক্ষ তথা সরকারেরই দায়, এই মনোভাবও ক্ষতিকর। সচেতন হতে হবে নাগরিককেও। জ্বর মানেই তা ভাইরাল, এই মরসুমে একটু-আধটু হয়— বলে অবহেলাও নাগরিক অসচেতনতা, বাড়ির পাশে খোলা জায়গা নর্দমা বা বাগানে নিজেরাই জঞ্জাল ফেলা, ফুলের টব বা ডাবের খোলায় জল জমতে দেওয়াও নাগরিক কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়। সরকারের ব্যবস্থাপনায় গলদ আছে ঠিক কথা, কিন্তু নাগরিক জীবনযাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনেক কিছুই কর্তৃপক্ষের সার্বিক নজরদারি এড়িয়ে যেতে পারে। তা নিয়ে সতর্ক হতে হবে নাগরিককেও। এই সচেতনতার বিকল্প নেই।