রাজনীতির ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খেলার প্রতিভা এখনও চমকপ্রদ। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিবাদী অবস্থান এবং তাকে কেন্দ্র করে নাগরিক সমাজের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ— প্রতিস্পর্ধী আন্দোলনের সম্মিলিত চাপে রাজ্য সরকার তথা তার সর্বময়ী নেত্রীর পিঠ কার্যত দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতি থেকে বিস্তর টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে শেষ অবধি সোমবারের বৈঠক এবং তাঁর মধ্যরাত্রির ‘সমাধানসূত্র’— নাটকীয় বললে কম বলা হবে। জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির অবসান হয়তো এখনও সময়সাপেক্ষ, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠা খেলাটিতে মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। এবং সর্বনাশ সমুৎপন্ন হলে যে সর্বদা অর্ধেক ত্যাগ করতে হয় না, সেটাও প্রমাণ করেছেন তিনি। তাঁকে এই আন্দোলনের সামনে কয়েক পা পিছু হাঁটতে হয়েছে, চাপে পড়ে প্রশাসনিক রদবদল ঘটাতে হয়েছে, যা তাঁর মতো আত্মময় রাজনীতিকের পক্ষে কম কথা নয়। কিন্তু প্রতিপক্ষের চিহ্নিত আধিকারিকদের ‘অপসারণ’-এর দাবি শেষ অবধি যে ভাবে তাঁদের এক পদ থেকে অন্য পদে ‘স্থানান্তর’-এ পর্যবসিত হল, তাতে সেই দাবির মর্যাদা কত শতাংশ রক্ষিত হল, বলা শক্ত। চিকিৎসক এবং নাগরিকদের প্রতিবাদী সক্রিয়তা তাঁকে নতুন পরীক্ষায় ফেলতে পারে, কিন্তু সেটা খেলার পরের রাউন্ড।
মুখ্যমন্ত্রীর প্রকৃত পরীক্ষা এখন স্পষ্টতই তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। আর জি করের পৈশাচিক ঘটনা ও তার সূত্র ধরে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনাচার ও দুর্নীতির তদন্তের উপর সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি চলছে এবং চলবে। লক্ষণীয়, পর পর দু’টি শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা চিকিৎসকদের কর্মবিরতিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি, বরং বিচারপতিদের সওয়ালে ও মন্তব্যে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিই সমধিক গুরুত্ব পেয়েছে। অতঃপর, আজ না হোক কাল কর্মবিরতির পালা চুকলে, ওই অস্ত্রটি পুরোপুরি হাতছাড়া হবে, আত্মরক্ষাই হয়ে উঠবে রাজ্য সরকারের একমাত্র কাজ। দৃশ্যত, সেই কাজটি ক্রমশই কঠিনতর হচ্ছে। মঙ্গলবারের দীর্ঘ শুনানির পর্বে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি জানিয়েছেন, সিবিআই তদন্তে এ-যাবৎ যে সব তথ্য উঠে এসেছে তা কেবল ‘উদ্বেগজনক’ই নয়, ‘বিচলিত করে দেওয়ার মতো’। বিশেষত, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের সম্ভাব্যতা যে ভাবে প্রবল আকার ধারণ করছে, পুলিশ-সহ সরকারি ব্যবস্থার বিভিন্ন মহলের আচরণ নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় যে ভাবে ঘনীভূত হচ্ছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগও দ্রুত বেড়ে চললে বিস্ময়ের কারণ নেই।
উদ্বেগ কেবল একটি ঘটনা নিয়ে নয়। বড় রকমের প্রশ্ন উঠেছে রাজ্য প্রশাসনের বাস্তব কর্মক্ষমতা এবং নৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে। রাজ্য সরকার মহিলা-কর্মীদের ‘নিরাপত্তা’র নামে তাঁদের কাজের অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করার উৎকট নির্দেশিকা যে ভাবে সর্বোচ্চ আদালতের ভর্ৎসনা কুড়িয়ে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হল, তা কেবল নীতিকারদের তমসাচ্ছন্ন মানসিকতা এবং চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতাকেই উন্মোচিত করেনি, তাঁদের দিশাহারা অবস্থাও এর ফলে সম্পূর্ণ প্রকট। তদন্তের ডালাগুলি যদি অতঃপর একের পর এক খুলতে থাকে, তার ভিতরের খবরগুলি জনসমক্ষে আসতে থাকে, কেবল রাজনৈতিক কৌশল এবং নাটক দিয়ে সামাল দেওয়া যাবে কি? পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির সামনে একটি প্রশ্ন ক্রমশই অতিকায় হয়ে উঠছে। রাজ্য প্রশাসন যাঁদের করায়ত্ত, তাঁরা কি সেই প্রশাসনের ঘুণ-ধরা কাঠামোয় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন বা চাইবেন? কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত, বিচারবিভাগের নজরদারি এবং সামাজিক আন্দোলনের ত্রিফলা অভিযান তাঁদের বেসামাল করতে পারে, আত্মশুদ্ধির তাড়না দিতে পারবে কি? এখনও অবধি তেমন কোনও লক্ষণ নেই।