পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করলেন আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দেখা গিয়েছে, বিজ্ঞানের বড় বড় ঘোষণা কোনও বিজ্ঞানীর পরিবর্তে খোদ প্রেসিডেন্ট করেন। মহাকাশচর্চায় সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের সাফল্য যখন আমেরিকাবাসীর মাথাব্যথার কারণ, তখন তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন ফিটসজেরাল্ড কেনেডি ঘোষণা করেন, ১৯৬০-এর দশক শেষ হওয়ার আগেই আমেরিকা চাঁদে মানুষের পদার্পণ ঘটাবে। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন অ্যাটম বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ করলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান জানান, আমেরিকা অ্যাটম বোমার চেয়ে হাজারগুণ বেশি ধ্বংসাত্মক হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করবে। ট্রুম্যান বা কেনেডির ঘোষণার এই অর্থ করা যায় যে, ও-সব ঠান্ডা লড়াইয়ের অংশবিশেষ। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রেগন ঘোষণা করেন যে, আমেরিকা সুপার কনডাক্টিং সুপার কোলাইডার বানিয়ে হিগস বোসন বা ঈশ্বরকণা খুঁজবে। তা অবশ্য বানানো যায়নি। খরচের ভয়ে মাঝপথে আমেরিকা কাজ বন্ধ করে দেয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর ঠান্ডা লড়াই অন্তর্হিত। ২০০০ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট তা প্রকাশ করেন। বাইডেনও জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা মহাশূন্যের ছবি প্রকাশ করে তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসরণ করেছেন। নিজেদের রেটিং জনমানসে বাড়ানো প্রত্যেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টের কর্তব্য। বাইডেনের ভাবমূর্তি এই মুহূর্তে ভাল নয়। মুদ্রাস্ফীতি, তেলের দাম, বন্দুক নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের ভ্রূণহত্যা বিরোধী রায়ে দেশে ক্ষোভ প্রবল। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো ছবি বিলক্ষণ কাজে লাগল।
স্পেস বা মহাশূন্যে ভাসমান টেলিস্কোপের বড় সুবিধা এই যে, পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলের অসুবিধা ওখানে নেই। পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে যে বাতাস, তা অনেক কিছু দেখতে দেয় না, বা সে সব বস্তুর সঠিক পরিচয় জানা যায় না। দূরবিন মহাকাশে ভাসমান হলে অসুবিধে নেই। ১৯২০-র দশকে এ রকম টেলিস্কোপের কথা ভাবা হলেও, আমেরিকা প্রথম স্পেস টেলিস্কোপ পাঠায় ১৯৬৮ সালে। তার পর অনেক দূরবিন মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। হাবল টেলিস্কোপ এবং চন্দ্র এক্স রে অবজ়ারভেটরি মহাশূন্যে পাঠানো হয় যথাক্রমে ১৯৯০ ও ১৯৯৯ সালে। দু’টি টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল এবং নোবেলবিজেতা চন্দ্রশেখর সুব্রহ্মণ্যমের নামাঙ্কিত। হাবল প্রসারণশীল ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা প্রবর্তন করেন, সুব্রহ্মণ্যম নক্ষত্রের বিবর্তনের গবেষণা করে প্রসিদ্ধ হন। এর মধ্যে হাবল বিপাকে পড়ে উৎক্ষেপণের পর। বহু কষ্টে তার ক্যামেরা মেরামত করা হয়। মেরামতি করা গিয়েছিল, দূরবিনটি মাত্র ৫৪০ কিলোমিটার দূরে মহাশূন্যে ভাসমান থাকায়।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। ১৯৯০-এর দশকে যে দূরবিনের মহাশূন্যে যাওয়ার কথা ছিল, তা শেষ পর্যন্ত যায় ২০২১ সালে ডিসেম্বরের শেষে। খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ কোটি ডলার থেকে ১০০০ কোটি ডলার। খরচ সার্থক। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ইনফ্রারেড ক্যামেরা যে সব ছবি তুলেছে, তা হাবল টেলিস্কোপেও তোলা সম্ভব হয়নি। হাবল যে-সব তরঙ্গ দেখেছিল, জেমস ওয়েবের শনাক্ত তরঙ্গের দৈর্ঘ্য তার প্রায় কুড়িগুণ। বিগ ব্যাং-এ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর বিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। স্পেস বা শূন্যস্থান বাড়ছে। আলোর তরঙ্গের দৈর্ঘ্যও বাড়ছে। দীর্ঘতর তরঙ্গ ক্যামেরায় শনাক্ত করার এই সুবিধা। বিগ ব্যাং-এ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মাত্র ৬০ কোটি বছর পরের গ্যালাক্সিপুঞ্জের অবস্থা কেমন ছিল, তা দেখতে পেয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। ১৩৭০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং থেকে সময়ের শুরু। ১৩১০ বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের অবস্থা কেমন ছিল, তা জানিয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। আর কী চাই?