ইতিহাসের সহিত রাজনীতির সম্পর্ক বহুস্তরীয়। ইংরেজ উপনিবেশে সাহেব-সিভিলিয়ানরা বহু ক্ষেত্রেই পুরাতন ভারতের অতীত সন্ধানে আগ্রহী হইতেন। অতীত আর ইতিহাস সমার্থক শব্দ নহে। যাহা ঘটিয়াছিল তাহা অতীত, সেই অতীতকে প্রমাণ সাপেক্ষে কার্য-কারণ পরম্পরায় দাখিল করাই ইতিহাসের কাজ। ইতিহাসকার ঘটনার ক্রম ও পরিণতিকে বদল করিতে পারেন না বটে, কোনও ঘটনা সম্বন্ধে বর্তমানের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারেন। ইহাই ইতিহাসের নির্মাণ, সেই স্থলেই ইতিহাসের মধ্যে বর্তমান রাজনীতির স্বার্থ বাসা বাধিয়া থাকে। অতীতের নথিপত্রকে প্রয়োজন মতো বাদ দিয়া, নির্বাচন করিয়া বর্তমানের স্বার্থসিদ্ধি করা রাজনৈতিক প্রকল্প। ইংরেজ শাসনকালে এই প্রকল্প বিশেষ কৌশল হইয়া উঠিয়াছিল। অতীত নির্মাণকালে প্রমাণ হিসাবে সেই সকল নথিপত্রই সাহেবরা দাখিল করিতেন, যেগুলি তাঁহাদের প্রশাসনিকতার পক্ষে উপযোগী। যেমন, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, অ্যাজ় টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টরিয়ানস নামক সঙ্কলন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিল সার্ভেন্ট এইচ এম ইলিয়টের সংগৃহীত নথির সাহায্যে ভারতের অতীত সম্বন্ধে প্রমাণ দাখিল করিলেন অধ্যাপক জন ডাওসন। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডে ভারতে মুসলিম আমলের চিত্র রহিয়াছে, সঙ্কলিত নথি অনিবার্য ভাবেই নির্বাচিত। হিন্দু-মুসলমান বিভেদের কথা প্রমাণে সাদা-সাহেবেরা তৎপর। এই বিভাজন প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলে তাঁহারা ঔপনিবেশিক শাসন সহজে বজায় রাখিতে পারিবেন। হিন্দু-মুসলমান এককাট্টা হইলে ইংরেজদের বিপদ। তাঁহাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’ ব্যর্থ হইবে।
বিভেদের রাজনীতি নানা সময়ে নানা ভাবে প্রকট হইয়া উঠে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে যে রদবদলে উদ্যত, তাহা হিন্দু অতীত ও মুসলমান আমলকে জনমানসে বিশেষ ভাবে তুলিয়া ধরিতে চাহে। দুইটি নীতি এক্ষণে অনুসৃত হইতেছে। প্রথম লক্ষ্য, হিন্দু অতীতের মধ্যে যে উদারনৈতিক বৈচিত্র রহিয়াছে সেই বৈচিত্রের কথা ভুলাইয়া দেওয়া। দ্বিতীয় লক্ষ্য, ভারতের নিজস্ব ইসলামি সভ্যতার রূপ ও রীতি সম্পর্কে জনমানসে ইতিবাচক ধারণা গড়িয়া উঠিতে না দেওয়া। এই দুই নীতিই মূলত একটি উদ্দেশ্যই সাধন করিতে চাহে। ভারতবর্ষের অতীত হিসাবে হিন্দু ঐতিহ্যের একমাত্রিক একটি কাঠামো তৈরি করিলে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভূত লাভ। তাই ইতিহাসের নব্য পাঠ্যসূচিতে কালিদাসের ঠাঁই নাই, আকবরের আমল সঙ্কুচিত হইয়াছে। মহাকাব্যের বদলে পৌরাণিক গল্পের আসর জমাইবার প্রচেষ্টা। কালিদাসের কাব্যে যে উদার ভোগকুশল জীবনের চিত্র রহিয়াছে, তাহা সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদীদের না-পসন্দ। আকবর যে মৈত্রীর কথা বলিতেন, তাহা লইয়া বেশি কথা বলিলে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ প্রতিষ্ঠা হইবে কেমন করিয়া? আকবর রামায়ণ-মহাভারতের কদর করিতেন, হিন্দু রাজন্যবর্গের ধর্মে হস্তক্ষেপ করিতেন না, এ সব কথা ইসলাম-বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী ভারত শুনিতে নারাজ। অতঃপর বেবাক বাদ, অপসারণই উপায়। যদিও হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের উপর স্বদেশি মার্কা বসাইতে ভালবাসেন, তথাপি তাঁহাদের পদ্ধতিটি নিতান্তই অর্বাচীন, ইংরেজ ঔপনিবেশিক পর্বের ‘হ্যাংওভার’: সেই মৌতাত হিন্দুত্ববাদীরা বজায় রাখিতে প্রাণ পণ করিয়াছেন।
তাঁহাদের অতীত নির্মাণের ‘ইতিহাস-নীতি’ যে কাট-ছাঁটের উপর দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, সেই কাট-ছাঁটের রণকৌশল এক্ষণে সকল ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর হয়। যে মতাদর্শ তাঁহাদের সঙ্গে মিলিতেছে না, সেই মতাদর্শের অধিকারী মানুষদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য রাষ্ট্র অতিমাত্রায় সক্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। আন্তর্জাল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিশেষ নীতি আসিয়াছে। আন্তর্জালে কী বলা যাইবে এবং কী বলা যাইবে না, তাহার বিধি প্রস্তুত। হিন্দুত্ববাদীরা যাহা দেশ-বিরোধী এবং অপ্রিয় কিংবা সমালোচনামূলক বলিয়া মনে করিবেন, তাহা বাদ পড়িবে। ইতিহাস হইতে আন্তর্জাল সর্বত্র এক নীতি, ইহাতে ভারতীয় ঐতিহ্যের মূলেই কুঠারাঘাত করা হইতেছে। ভারতীয়েরা যে দর্শনপন্থার বিরোধিতা করিতেন, সেই দর্শনপন্থাকে পূর্বপক্ষ হিসাবে উদ্ধৃত করিতে ভুলিতেন না। নীরবতার, অপসারণের ও কণ্ঠরোধের ঐতিহ্য ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী। অথচ হিন্দুত্ববাদীরা নয়কে হয় করিতেছেন, বৈচিত্রকে ধ্বংস করিতেছেন, ইতিহাসের কণ্ঠ রোধ করিতেছেন। ভারতীয় দার্শনিকগণ বলেন, কালের গতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়— এই সঙ্কীর্ণ সাংস্কৃতিক রাজনৈতিকতার বদল হইবেই।