ভাষার সৌজন্য এ দেশে জনজীবনের সমস্ত পরিসরেই উত্তরোত্তর দুর্লভ হয়ে পড়ছে। রাজনীতি বা প্রশাসনের সর্বস্তরে তো দুর্বিনয়ের সাম্রাজ্য অনেক দিন ধরেই অপ্রতিহত, কিন্তু বিদ্যাচর্চার জগতেও ইদানীং সেই প্রবণতাই প্রবল। মন্ত্রী-সান্ত্রি বা তাঁদের পারিষদবর্গ তো অনেক দিন ধরেই প্রতিনিয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কটু কথায় ও কর্কশ স্বরে নিজেদের দাপট দেখিয়ে বেড়ান, কিন্তু যাঁরা শিক্ষাবিদ হিসাবেই পরিচিত ও স্বীকৃত, তাঁরাও অনেকেই এখন একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর চেয়ারপার্সন এম জগদেশ কুমার সম্প্রতি কলকাতায় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমাবর্তন উপলক্ষে এসেছিলেন। সেখানে কথা ওঠে যে, পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প চালানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের যথেষ্ট অনুদান পাচ্ছে না। এই অনুযোগের জবাবে তিনি বলেছেন: অনুদানের টাকা কাউকে ‘থালায় সাজিয়ে’ দেওয়া হবে না, অনুদান পাওয়ার যোগ্য হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে এমন ভাষা কারও যদি কর্কশ বলে মনে হয়, তবে বুঝতে হবে, তিনি এখনও এই জমানার বাগ্ধারায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি।
প্রতিপ্রশ্ন উঠতে পারে: ইউজিসি-র কর্ণধারের বক্তব্যটি কি অযৌক্তিক? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, গবেষণা প্রকল্পে অনুদান মঞ্জুর করার জন্য সেই প্রকল্পের যৌক্তিকতা ও গুণমান যথেষ্ট ভাল হওয়া দরকার। এই প্রাথমিক শর্ত পূর্ণ না হলে গবেষণার নামে অর্থ ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো এবং সংসাধনের অপচয় হতে পারে। এ দেশে দীর্ঘকাল ধরেই বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তেমন অপচয়ের অগণন নজির রচিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। অবান্তর বিষয়ে গবেষণা, মাঝারি বা নিম্ন মানের গবেষণা, গবেষণার নামে নানা ধরনের প্রবঞ্চনা— সব রকমের অনাচার অতি পরিচিত। সরকারি অর্থের এমন অপব্যবহার বন্ধ করা অবশ্যই জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা পরিচালকরা সেই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ও সক্রিয় থাকলে এমন অনাচারের ছয়লাপ হত না, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা সেই দায়িত্ব পালন করেন না, উপরন্তু অপচয়ের পিছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনুদানের ‘যোগ্যতা’ যাচাইয়ের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু ইউজিসি তথা তার পশ্চাদ্বর্তী কেন্দ্রীয় সরকার কি সত্য সত্যই সেই যোগ্যতা নির্ধারণে সমর্থ? বা, আদৌ সেই কাজে আগ্রহী? জগদেশ কুমার জানিয়েছেন, গবেষণা-প্রস্তাব কী ভাবে লিখতে হয়, প্রকল্পের ফলিত প্রয়োগ কী ভাবে করতে হয়, তার ভিত্তিতে স্টার্টআপ কী ভাবে চালাতে হয়, সেই সব বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ-সবই গবেষণার পদ্ধতিগত ব্যাপার এবং তার বাণিজ্যিক প্রয়োগের প্রশ্ন। প্রশ্নগুলি অদরকারি নয়, কিন্তু গবেষণার উৎকর্ষের প্রশ্নটি স্বতন্ত্র ও মৌলিক। ইউজিসি কর্তার বক্তৃতাই বুঝিয়ে দেয়, সেই মৌলিক জ্ঞানচর্চার বিষয়ে তাঁর বা তাঁদের সম্যক ধারণাই নেই। গবেষণা তাঁদের কাছে বাজারের পণ্য। তার অনুসারী চিন্তাভাবনা এবং প্রকরণগুলিকেই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার পরিসরে বেমালুম প্রয়োগ করতে চান, জ্ঞানচর্চার উৎকর্ষ নয়, কে কত ঝকঝকে ‘প্রেজ়েন্টেশন’ করতে পারলেন সেটাই হয়ে ওঠে কৃতিত্ব যাচাইয়ের মাপকাঠি। শিক্ষা বিষয়ক ভাবনার এই দৈন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর রাজনৈতিক তথা আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য বিস্তারের উদগ্র বাসনা। ইউজিসি বরাবরই শিক্ষার ভুবনে রাষ্ট্রীর কর্তৃত্ব জারি করার প্রকরণ ছিল, কিন্তু বর্তমান শাসকরা তাকে সর্বগ্রাসী আধিপত্যের অভূতপূর্ব নিদর্শন বানাতে বদ্ধপরিকর। এই চিন্তাধারাই বোধ করি প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের ভাষায় প্রতিফলিত হয়। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে উঠে তাঁরা এমন সুরে কথা বলেন, যা শুনে হরিতকী গ্রামের বাঘা বাইন বলে উঠবেন: কী দাপট!