একটি বিষয়ে সন্দেহ নেই। দেশ জুড়ে বাঘ নিয়ে যতই হইচই পড়ুক, আসলে এই শহরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন মানুষখেকোরা— রাস্তাঘাটে বেপরোয়া বাস ও অন্যান্য যানবাহন। যখনতখন তারা নিবিয়ে দিতে পারে সংসারের আলো, রক্ত ধুয়ে ফের ছুটতে শুরু করে হৃদয়হীন শহর, যত ক্ষণ না ফের কারও সামনে প্রিয়জনের শব ফেলে দেয় দানবীয় চাকা। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সকালগুলো শুরু হচ্ছে এমনই অন্ধকারে। গত সপ্তাহে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে এক পরিবারেরই তিন স্কুটি-আরোহীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরের সপ্তাহের সোমবারেই জোড়া বিভীষিকা। ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে বৃদ্ধা প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে বাসচাপা পড়েছেন, এক্সাইডে মধ্যবয়স্কা রোটারি সদনে অনুষ্ঠানে যেতে গিয়ে পিষে গিয়েছেন। বধ্যভূমিগুলি মানুষের এতই পরিচিত, এখন বাড়ির মানুষ রাস্তায় বেরোলেই বাড়ির অন্যদের আতঙ্কযাপন।
দুই ক্ষেত্রেই ‘ব্লাইন্ড স্পট’-এর কথা শুনিয়েছে পুলিশ। বলতে চাইছে সিগন্যাল, বাস স্টপের সামনে পথচারী যানের কাছ ঘেঁষে পারাপার করেন, উঁচুতে বসা চালক তাঁদের দেখতে পান না। চালকদের কর্মশালা, হোর্ডিংয়ে, সমাজমাধ্যমে সচেতনতাবৃদ্ধি নিয়ে তাদের একগুচ্ছ আশ্বাসও মিলেছে। বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে, বিভিন্ন রাস্তায় যানবাহনের গতি নির্দিষ্ট করা হবে। কিন্তু, গাড়ির গতি বাঁধার কথা বললেই কি থামবে দুর্ঘটনা? অভিজ্ঞতা বলছে, না। জীবনহানির অব্যবহিত পরে গাত্রোত্থান করে কয়েকটি জোড়তাপ্পি দেওয়া ব্যবস্থার কুমিরছানা দেখিয়ে ফের ‘যা চলছে তা-ই চলুক’ এই জড়তার আশ্রয়ে গেলে কিছু মুখ বন্ধ করা যায়, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে না। পর দিনই বাকি সব রাস্তায় ও সাত দিনের মধ্যে অকুস্থলে গেলে ফের ঝুঁকির পারাপার ও খ্যাপা বাসের লড়াই দেখা যাবে।
প্রশ্ন হল, মানুষকে ‘ব্লাইন্ড স্পট’-এ যেতে হয় কেন? কেননা পথ বেহাল। গাড়িরাস্তা ও পথচারীর পরিসর আলাদা নির্দিষ্ট থাকলে ও তা অমান্যের উপায় না রাখলেই দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। অথচ পথ-দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির মিছিল থামানো একটুও মুশকিল নয়। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায় বহু আলোচিত। রাস্তাগুলির স্বাস্থ্যোদ্ধার ও আয়তন বৃদ্ধি, মোবাইলে লাগাম, দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গা চলাচলের বিশেষ ব্যবস্থা, যে যানগুলি দুর্ঘটনা ঘটায় সেগুলির নিয়মিত পরীক্ষা, চালককে পথনির্দেশ ও সিগন্যাল ব্যবস্থার কঠোরতা আরোহী ও পথচারীকে সুরক্ষিত করে। চালকের স্টিয়ারিং হাতে চমকানোর প্রবৃত্তিকে শায়েস্তা করতে পারে ডিজিটাল নজরদারি। কিন্তু, প্রযুক্তি-দক্ষতা প্রয়োগ করতেও প্রশাসনের গড়িমসি। জোড়া দুর্ঘটনার আগের রাতে হাওড়ায় মহিলার অপমৃত্যু সে সন্দেহকে জোরদার করে। সেখানে ঘাতক-বাইকটির চালক ও তাঁর শাসক-ঘনিষ্ঠ আরোহীর মত্ততার, সত্য আড়ালের চেষ্টার খবর মিলছে। কলকাতার গাড়ি-রাস্তা যতটা অপ্রতুল, শহর কিন্তু সেই সাপেক্ষে মন্থর নয়। এতেই প্রমাণিত ট্র্যাফিক বিভাগ চাইলে সুষ্ঠু ভাবে শহর সচল রাখতে পারে। কিন্তু, উপর্যুপরি সড়ক-দুর্ঘটনা, সিসিটিভি ঘিরে ঔদাসীন্য তাদের গাফিলতি ও দুর্নীতিতে প্রশ্রয়েরই লক্ষণ। দোষীরা ছাড় পেতেই অভ্যস্ত। আইন-শৃঙ্খলাকে তাচ্ছিল্য, ক্রয়যোগ্য ধরে নেওয়ার প্রবণতাকে দমন না করলে তাণ্ডব কোন জায়গায় যেতে পারে, তারও নজির রয়ে গিয়েছে সপ্তাহ শুরুর মাঝরাতে, ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে, নৃত্যশিল্পীর জীবন-যবনিকায়।