আদালত এমন ‘অগণতান্ত্রিক’ নিষেধাজ্ঞা জানাতে অস্বীকার করেছে।
সর্বোচ্চ আদালতের মন্তব্য শুনে বহুযুগের ও-পার হতে ভেসে এল সুরসিক শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বা দাদাঠাকুরের অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিগুলি: ভোট দিয়ে যা/ আয় ভোটার আয়/ মাছ কুটলে মুড়ো দেব/ গাই বিয়োলে দুধ দেব/ দুধ খাবার বাটি দেব...। সে-কালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সে-কালের মাপ মতো হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। ভোট পাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতির বহর কালে কালে বেড়েছে, মূল সুরটি পাল্টায়নি। নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ভোটদাতাদের নানাবিধ পারিতোষিক পাইয়ে দেওয়ার কথা অকাতরে ঘোষণা করে চলেন রাজনীতির কারবারিরা। প্রার্থীর নিজস্ব প্রতিশ্রুতি ক্রমে ক্রমে গৌণ হয়ে পড়েছে— এখন সবার উপরে দল সত্য, তারও উপরে দলনায়ক এবং নায়িকা। তাঁরা আপন দলকে ভোটে জিতিয়ে আনার জন্য যে সব প্রতিশ্রুতি অকাতরে বিতরণ করেন, সেগুলি সারি সারি সাজিয়ে সিঁড়ি বানালে অনায়াসে হাতে চাঁদ পাওয়া যাবে। প্রতিশ্রুতি আর প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান স্বভাবতই আকাশ-পাতাল— এখন অবশ্য নেতারাই অম্লানবদনে জানিয়ে দেন যে, ভোটের সময় যা যা দেওয়া হবে বলে প্রচার করা হয়, সে-সব কথাকে বেশি গুরুত্ব দিতে নেই, ওগুলো ‘জুমলা’।
তবে যা রটে, তার যেটুকু ঘটে, সেটাও কম নয়। জুমলার ফাঁকফোকর দিয়ে রকমারি বরাদ্দ স্থির করা হতে থাকে, ভোটদাতাদের খুশি করতে বাজেটের নানা খাতে অনেক টাকা ধরতে হয়। বস্তুত, এই ছবি আজ আর কেবল ভোটের সময়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, সম্বৎসরই দানসত্র চলতে থাকে। আর সেই সূত্রেই উচ্চারিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যটি। সর্বোচ্চ আদালতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে বলা হয়েছিল, ভোট পাওয়ার তাগিদে খয়রাতির প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক, এমনকি যে দল এমন খয়রাতির আশ্রয় নেবে তার স্বীকৃতি বাতিল করা হোক। আদালত সঙ্গত কারণেই এমন ‘অগণতান্ত্রিক’ নিষেধাজ্ঞা জানাতে অস্বীকার করেছে। কিন্তু আবেদনের পিছনে যে যুক্তি থাকতে পারে, বিচারপতিরা সে-কথা অস্বীকার করেননি। আদালতের মতে, খয়রাতির সঙ্গে অর্থনীতির যুক্তির একটা ভারসাম্য থাকা দরকার, তা না হলে জনকল্যাণের নামে খয়রাতি করতে গিয়ে উন্নয়নের ক্ষতি হবে। তাঁরা মনে করেন, এই গুরুতর প্রশ্নটি নিয়ে পর্যালোচনার জন্য একটি প্যানেল তৈরি করার প্রয়োজন আছে, যার সদস্যরা এই বিষয়ে সমস্ত ধরনের মতামত ও যুক্তি-তথ্য খতিয়ে দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় ভারসাম্যের সূত্র নির্ধারণ করবেন।
কাজটা যে কঠিন এবং জটিল, সে-কথা বিচারপতিরাও অস্বীকার করেননি, বরং জানিয়েছেন যে, বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে ভাববার প্রয়োজন আছে। প্রশ্ন হল, সেই ভাবনার ভিত্তিভূমি কী হবে? উন্নয়ন বনাম খয়রাতি— এই অবস্থানটিকে ধরে নিয়ে যদি ভাবনা শুরু হয়, তা হলে প্রথম থেকেই উত্তরটা স্থির হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সে-উত্তর এই যে, খয়রাতি চলবে না, কারণ তাতে বিনিয়োগের সংস্থানে টান পড়বে, সুতরাং উন্নয়নের ক্ষতি হবে। এই অবস্থানকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না, কারণ ভারতের মতো দেশে উন্নয়নী বিনিয়োগের সংস্থান সত্যই সীমিত, অথচ তার প্রয়োজন অপরিসীম। কিন্তু মুশকিল হল, ভারতের মতো দেশে বিনিয়োগ-সঞ্জাত উন্নয়নের অদ্বিতীয় লক্ষ্য নিয়ে আর্থিক নীতি রচনা করতে গেলে অসংখ্য নাগরিককে আক্ষরিক অর্থেই জীবন বিসর্জন দিতে হবে, কারণ উন্নয়নের সুফল তাঁদের হাতে পৌঁছয় না, কত প্রজন্মের মধ্যে পৌঁছবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। অতএব নিছক জীবনধারণের জন্যই তাঁদের সাহায্য করা জরুরি, যে সাহায্য কার্যত খয়রাতির আকার ধারণ করতে বাধ্য। এখানেই জনকল্যাণের সঙ্গে খয়রাতির সম্পর্ক। সমস্যার আসল কারণ হল এই সম্পর্কটিকে ক্ষমতা দখল করার বা ধরে রাখার তাগিদে ব্যবহার করার উদগ্র এবং অদম্য তাগিদ। এই তাগিদ প্রবল হয়ে উঠলে খয়রাতি বা অনুদান আর জনকল্যাণের লক্ষ্যে চালিত হয় না, চালিত হয় ভোট সংগ্রহের লক্ষ্যে। তার সুবাদেও কিছু জনকল্যাণ হতে পারে, দুধ খাওয়ার বাটিও ফেলে দেওয়ার নয়। কিন্তু যে ভারসাম্যের কথা আদালত বলছে, নির্বাচন-সর্বস্ব রাজনীতি তার তোয়াক্কা করে না, করতে পারে না— কারণ, তার একমাত্র লক্ষ্য যে ভাবে হোক নিজের ভোট বাড়ানো। এখানেই সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যের গুরুত্ব। স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের শোরগোলে এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি যেন ঢাকা না পড়ে।