Kasba

বুট নিষ্পেষণ

পুলিশের বুট কেবল চাকরিহারা শিক্ষকের গায়ে লাগেনি, লেগেছে রাজ্যবাসীর বুকে। এই অবমাননার গ্লানি স্পর্শ করেছে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে।

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:২০
Share:

শিক্ষকদের উপর পুলিশের পদাঘাত, পুলিশের পা জড়িয়ে ধরে শিক্ষকদের মিনতি— সামূহিক স্মৃতিতে এই দৃশ্য খোদাই হয়ে রইল যন্ত্রণা আর লজ্জার আঁচড়ে। পুলিশের বুট কেবল চাকরিহারা শিক্ষকের গায়ে লাগেনি, লেগেছে রাজ্যবাসীর বুকে। এই অবমাননার গ্লানি স্পর্শ করেছে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে। পুলিশের এই অকারণ হিংস্রতাকে মানুষ ‘সামান্য ব্যাপার’ বলে মেনে নেবেন, ভুলে যাবেন, এমন প্রত্যাশা যেন না করে তৃণমূল সরকার। প্রশাসনে অনিয়ম ও দুর্নীতির জেরে যাঁরা তালিকায় স্থান পাননি, আর যাঁরা স্থান পেয়েও চাকরি হারালেন, তাঁদের প্রতি রাজ্যবাসীর পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রশ্ন করেছেন, শিক্ষকরা ডিআই অফিসে গিয়েছিলেন কেন? তাঁকে প্রশ্ন করা দরকার, কেন নয়? ডিআই অফিসে বিক্ষোভ দেখানোর, স্মারকলিপি জমা দেওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে শিক্ষকদের। সরকারি দফতরের দরজায় তালা লাগিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ নতুন কিছু নয়। ডিআই দফতরে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দলকে শান্তিপূর্ণ ভাবে স্মারকলিপি পেশ করার ব্যবস্থা করে দেওয়া যেত। ডিআই অফিসের গেট বন্ধ না থাকলে তা টপকানোর চেষ্টা, তালা ভাঙার চেষ্টারও দরকার হত না। যদি সেই বিক্ষোভের মধ্যে হিংসা ও ভাঙচুর শুরু হয়, তা আটকাতে বা উচ্ছৃঙ্খলদের সংযত করতে পারে পুলিশ। কিন্তু তার জন্য এই হিংস্র আক্রমণ কেন? মাটিতে ফেলে লাঠিপেটা, মহিলাদের উপর পুরুষ-পুলিশের আক্রমণ— এ সব কি আইনের শাসন, না কি শাসকের আইন লঙ্ঘন?

অথচ, ধৈর্য ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে বিক্ষোভ কর্মসূচির মোকাবিলা করেছে পুলিশ, এমন নিদর্শন কম নেই। বুধবার প্রায় সব জেলায় ডিআই দফতরে শিক্ষকদের কর্মসূচি সামলেছে পুলিশ। কেবল কলকাতায় শিক্ষকদের পিটিয়ে পুলিশ লাঠি ভেঙে ফেলল, ভূলুণ্ঠিত শরীরে পুলিশের বুটের ছাপ পড়ল। আশঙ্কা হয়, নাগরিকের দেহের উপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এই স্বাক্ষর অকস্মাৎ পড়েনি। এর একটি পূর্ব-নির্দিষ্ট ক্রম রয়েছে। প্রথমে ব্যারিকেড, অতঃপর পুলিশি আক্রমণ, তার পরে মিথ্যা মামলা— নাগরিকের প্রতিবাদের মোকাবিলার এই হল সরকারি রুটম্যাপ। আর একটি কৌশল, অপরাধীকেই ‘আক্রান্ত’ বলে দেখানো। এ বার যেমন পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা অভিযোগ করেছেন, ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’র আক্রমণে আহত পুলিশ চিকিৎসাধীন। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে, বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে পড়লে পুলিশ ‘পরিস্থিতি-বিচার’এ বুট-লাঠি ফেলে কেমন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে, তার নিদর্শন মিলেছিল গত ১৪ অগস্টের আর জি কর হাসপাতাল চত্বরে।

শিক্ষকদের এই প্রতিবাদ কর্মসূচি যথেষ্ট সঙ্গত। সরকারি ব্যবস্থার ব্যাপক অনিয়মের কারণেই কর্মহীন, সম্মানচ্যুত শিক্ষকরা রাস্তায় নেমেছেন। সরকার, বিশেষত শিক্ষা দফতর, এই শিক্ষকদের কাছে অপরাধী। তাঁদের প্রতিবাদ, ক্ষোভের উচ্চারণ নতমস্তকে শুনতে হবে প্রশাসনকে, তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। শান্তিভঙ্গের অভিযোগের পিছনে লুকোলে চলবে না। আর জি কর কাণ্ডের পরে লালবাজারে স্মারকলিপি দেওয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। সেই শান্তিপূর্ণ মিছিল বিশাল ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়েছিল। রাস্তায় অবস্থানকারী ডাক্তারদের প্রতি জনসমর্থনের জোয়ার দেখে ক’দিন পর পুলিশই ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য হয়েছিল। এ বারেও আক্রান্ত, অপমানিত শিক্ষকরা আরও বৃহৎ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একরাশ আশ্বাসবাণী বিতরণ করেছেন, যার অনেকাংশই ভিত্তিহীন বলে প্রতীত হচ্ছে। তিনি ও তাঁর অনুচর-সহকর্মীরা মনে করতে পারেন, তাঁর আশ্বাসবাক্যের পর আর কথা চলে না। কিন্তু বৃহত্তর সমাজ অর্থাৎ শিক্ষক, চিকিৎসক, ছাত্রছাত্রী, কৃষক-শ্রমিকরা কিন্তু তার পরেও কথা বলতে চাইতে পারেন। তাঁদের কথা সরকারকে শুনতে হবে, পুলিশের বুট দিয়ে চেপে দিলে চলবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন