বিভিন্ন ঘাটতি গণতন্ত্রের ভিতটিকে একাধিক ভাবে দুর্বল করে। প্রতীকী ছবি।
কেবল দিকে-দিকে নয়, দলে-দলে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। কা চ বার্তা? না, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রজ্ঞা অনাবশ্যক। এই ক্ষণস্থায়ী শীতের বঙ্গভূমিতে রাজনৈতিক দলগুলির পরিসরে যে ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনি উঠেছে তার নাম: গ্রামে চলো। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস আগেই গ্রাম সংযোগের কর্মসূচি নিয়েছে, স্বাভাবিক সংযোগের উপরে আছে তাদের অ-স্বাভাবিক সংযোগ, যার নাম ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’, যে কবচ নিয়ে দিদির কয়েক সহস্র দল-দূত গ্রামে-গ্রামে ঘরে-ঘরে পাড়ি দিচ্ছেন। অতঃপর বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বও জানিয়ে দিয়েছে, এই মাসে দলের প্রায় দু’শো নেতাকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গ্রামে গিয়ে জনসংযোগে তৎপর হতে হবে। বিরোধী বাম দলগুলি আগেই এক প্রস্ত গ্রাম-যাত্রাসেরে রেখেছে, তদুপরি জেলায়-জেলায় ইতস্তত তাদের প্রতিনিধিরাও সতত সঞ্চরমাণ। এমন বহুস্রোতা দলতরঙ্গের অভিঘাতে বিধ্বস্ত গ্রামের মানুষ হয়তো মনে-মনে আবেদন করছেন: আর নহে, আর নয়।
তাঁরা অবশ্য বিলক্ষণ জানেন যে, সেই আর্তি এখন কেউ শুনবে না, কারও তা শোনার জো নেই। এখন ভোটের সময়। পঞ্চায়েত ভোট। ঢাকে কাঠি পড়তে আর বেশি দেরি নেই, গ্রামে-গ্রামে মহাযজ্ঞের আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে, অতএব এখন, অমোঘ নিয়মে এবং অনিবার্য গতিতে, সব পথ এসে মিলে গেল শেষে। শরৎ এলে আকাশে সাদা মেঘ ভেলা না ভাসাতে পারে, বিদ্যুতের খুঁটি এলে বিদ্যুৎ তো না আসতেই পারে, কিন্তু ভোট এলেই ভোটদাতা দেখবেন— দুয়ারে দলনেতা। বাকি সময়টা?এই প্রশ্নটি সচরাচর শাসক দলের সম্পর্কেই করা হয়ে থাকে। ক্ষমতা হাতে পেলেই আর তাঁরা জনসাধারণকে নিয়ে মাথা ঘামান না, এ-অভিযোগ বহুশ্রুত। কিন্তু প্রশ্নটি বিরোধী দল সম্পর্কে এক অর্থে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হওয়ার কথা। কারণ, কি কেন্দ্রে, কি রাজ্যে, শাসকরা সরকারি ক্ষমতা এবং কোষাগারকে নির্বাচনী মূলধন হিসাবে ব্যবহার করতে পারে এবং করে থাকে; কিন্তু বিরোধীদের ক্ষেত্রে জনসংযোগই প্রথম এবং প্রধান রাজনৈতিক মূলধন। শহরের তুলনায় গ্রামে তার প্রয়োজন সমধিক, অথচ সেখানেই নির্বাচনী মরসুমটুকু বাদ দিলে সচরাচর বড় রকমের ঘাটতি দেখা যায়।
এই ঘাটতি গণতন্ত্রের ভিতটিকে একাধিক ভাবে দুর্বল করে। প্রথমত, গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন অভাব-অভিযোগকে সংগঠিত দাবি এবং প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে শাসকের সামনে তুলে ধরা এবং তাদের সেই দাবি পূরণে ও অভিযোগের প্রতিকারে বাধ্য করাই বিরোধী রাজনীতির প্রধান দায়িত্ব। সম্প্রতি আবাস যোজনা সংক্রান্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলি সেই দায়িত্ব কিছুটা পালন করার চেষ্টা করছে, তার ফলে শাসকরা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছেন এবং সমস্যার আংশিক প্রতিকারের আশাও জেগেছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই উদ্যোগ যৎসামান্য। এবং, প্রয়োজন কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নয়, সরকারকে জনস্বার্থে সুনীতি রচনায় এবং সেই নীতির সুষ্ঠু রূপায়ণে বাধ্য করাও জরুরি। দ্বিতীয়ত, জনসাধারণকে, বিশেষত গ্রামের দরিদ্র, সুযোগবঞ্চিত, পশ্চাৎপদ নাগরিকদের নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা এবং সেই অধিকার আদায়ের দাবিতে তাঁদের সংগঠিত করার কাজটি যদি বিরোধী রাজনীতি না করে, তা হলে তাঁরা উত্তরোত্তর সরকারি দাক্ষিণ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন, তার পরিণামে নাগরিক ক্রমশই প্রজায় পরিণতহবেন। পশ্চিমবঙ্গে ঠিক সেটাই ঘটছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন আসবে এবং যাবে। বিরোধীরাও কি সেই সময়সারণি মেনেই যাতায়াত চালিয়ে যাবেন?