গত ফেব্রুয়ারিতেই লোকসভায় পেশ করা হয়েছে, এ বার কার্যকর হওয়ার পালা। নতুন ‘ইনকাম ট্যাক্স বিল ২০২৫’-এ বলা আছে, ভারত সরকার এখন থেকে নাগরিকদের ওয়টস্যাপ ও টেলিগ্রাম-এর মতো যোগাযোগ-প্ল্যাটফর্ম, এমনকি ইমেলও খতিয়ে দেখতে পারবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির হাত ধরে ইদানীং আয়কর ফাঁকি ও বেআইনি আর্থিক লেনদেন বেড়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো ‘ভার্চুয়াল অ্যাসেট’ তাকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। ১৯৬১-র পুরনো আয়কর আইন এই সব শনাক্তকরণে যথেষ্ট পোক্ত নয়, সে জন্যই এই নতুন বিল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী উদাহরণও দিয়েছেন, মোবাইল ফোনের ‘এনক্রিপ্টেড’ মেসেজের সূত্র ধরে সম্প্রতি সরকার আড়াইশো কোটি হিসাব-বহির্ভূত টাকা শনাক্ত ও বাজেয়াপ্ত করেছে, এমনকি কাজে দিয়েছে গুগল ম্যাপের ‘হিস্ট্রি’, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টও।
বলা হচ্ছে, এই সবই করা হবে যাতে সরকার আয়কর ফাঁকি, হিসাব-বহির্ভূত অর্থ, বেআইনি আর্থিক লেনদেন ধরতে পারে। কিন্তু সে কাজেই যে এই বিল তথা ভাবী আইনের ব্যবহার হবে, কদাপি তার অপব্যবহার হবে না, তার নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ অমূলক নয়। ভারতে ইদানীং যে কোনও নতুন বিল ঘিরে গুচ্ছের প্রশ্ন ও সংশয়— কখনও তার অস্বচ্ছতা বা ব্যাখ্যার ধোঁয়াশা ঘিরে, কখনও নাগরিকের মৌল স্বাধীনতায় তার হস্তক্ষেপ ঘিরে। নতুন আয়কর বিলটিও ব্যতিক্রম নয়। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়টস্যাপ-সূত্রে যে বেআইনি লেনদেন ধরার কথা বলেছেন তা একই সঙ্গে এই প্রশ্নও জাগিয়ে তোলে, সরকার ঠিক কী ভাবে ‘এনক্রিপ্টেড’ মেসেজের প্রবেশাধিকার পেল। ওয়টস্যাপের ‘এনক্রিপশন’ অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়, মেসেজের প্রেরক ও প্রাপকের মধ্যে যে বার্তা চালাচালি হচ্ছে তার গোপনীয়তা সর্বাংশে রক্ষাই তার কাজ। এনক্রিপশন-সংক্রান্ত নীতি নিয়ে ওয়টস্যাপের মতো মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে গত কয়েক বছর ভারত সরকারের সংঘাত চলছে। ঝামেলা গড়িয়েছে মামলায়, গত বছর সংস্থাটি দিল্লি হাই কোর্টে এমনও বলেছে যে, এনক্রিপশন-নীতিতে কোনও রকম আপস করতে হলে তারা ভারতের বাজার ছেড়ে চলেও যেতে পারে। নতুন আয়কর বিলের প্রেক্ষিতে এই দ্বৈরথ যে আবারও মাথাচাড়া দেবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
ভারত সরকার বনাম একটি মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের সংঘাতই এ ক্ষেত্রে সব নয়। আসল সমস্যা আরও গুরুতর— তা নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুরক্ষার সমস্যা। ডিজিটাল মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা ও বেআইনি লেনদেন বেড়েছে সত্যি কথা, তা রুখতে আইনেও যুগোপযোগী ও কঠোর হওয়া দরকার সেও সমান সত্য— কিন্তু তা করতে হবে এমন পন্থায় যাতে সরকারের হাতেই কোনও নাগরিকের হেনস্থা বা অমর্যাদা না হয়। এ অতি সূক্ষ্ম হিসাব: এক দিকে ডিজিটাল প্রযুক্তি সহায়ে বিপুল আর্থিক নয়ছয়ের কারবারিদের ধরতে হবে, অন্য দিকে খেয়ালও রাখতে হবে যাতে তা করতে গিয়ে নাগরিকের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে নাগরিকের অন্দরমহলে উঁকি দেওয়ার বিস্তর বদনাম রয়েছে, তাই না আঁচালে বিশ্বাস নেই। বেআইনি আর্থিক কারবারিদের ধরাই সরকারের উদ্দেশ্য, না কি লুকিয়ে নাগরিকদের মেসেজ-ইমেল পড়া, কে বলবে!