দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫ বছর পূর্তিতে যে পরিমাণ আড়ম্বর হয়েছিল, সংবিধান প্রণয়নের ৭৫ বছর পরে প্রজাতন্ত্র দিবসের আহ্বানে তার এক আনা উৎসাহ উদ্দীপনাও দেখা গেল না। স্বাধীনতা দিবসের নিজস্ব মহিমা অবশ্যই অতুলনীয়, কিন্তু সব বিষয়ে সতত উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে ওঠাই যে দেশের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বিশেষ উপলক্ষ থাকা সত্ত্বেও এমন নিস্তরঙ্গ প্রজাতন্ত্র দিবসকে কিঞ্চিৎ বিস্ময়কর মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেউ বলতে পারেন যে, আড়ম্বর বা শোরগোল যত কম হয় ততই মঙ্গল। সে-কথা ভুল নয়। বিভিন্ন ‘দিবস’ শান্ত এবং সংযত ভাবে উদ্যাপনের সু-অভ্যাস যদি ক্রমে ক্রমে কায়েম হয়, তা স্বস্তির কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অভাব উচ্ছ্বাসের, না আগ্রহের? সংবিধান সম্পর্কে এবং সাধারণতন্ত্রের ধারণা সম্পর্কে কি সরকারি মহলে, কি সামাজিক পরিসরে বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই বলেই কি ৭৫ বছর পূর্তির মতো একটি উপলক্ষেও হাতে রইল গতানুগতিক দৃশ্যাবলি: রাষ্ট্রীয় কুচকাওয়াজ, সমরসজ্জা, শোভাযাত্রা ও পুরস্কার ঘোষণা, বাণিজ্যিক বিপণনের প্রসার ঘটানোর জন্য বিশেষ ছাড় এবং নাগরিক চড়ুইভাতি?
অথচ সাম্প্রতিক কালে সংবিধান বারংবার নানা ধরনের আলোচনা, বিতর্ক এবং আন্দোলনের কেন্দ্রে এসেছে। পাঁচ বছর আগে নাগরিকত্ব যাচাই প্রকল্পের প্রতিবাদে ‘শাহিন বাগ আন্দোলন’-এর সময় দেশের নানা প্রান্তে সংবিধানের প্রস্তাবনা হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় শাসক শিবিরের দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিস্পর্ধী নাগরিকদের এক অসামান্য নৈতিক হাতিয়ার। বিরোধী রাজনীতিকরা, বিশেষত প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় স্তরের নেতারা বিভিন্ন উপলক্ষে সংবিধানের সারাৎসার সম্বলিত পুস্তিকা বা গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক ও সংসদীয় সভায় সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। শুধু এই ক্ষেত্রে নয়, শাসকরা কখনও সরাসরি, কখনও কৌশলে সংবিধানের উদার গণতান্ত্রিক চরিত্রটিকে বিপন্ন বা খর্বিত করার যে সব চেষ্টা চালিয়ে আসছেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং ক্ষোভবিক্ষোভ বিস্তর। শাসকরা প্রত্যাশিত ভাবেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে থাকেন এবং সংবিধানের প্রতি মৌখিক শ্রদ্ধা জানাতে কসুর করেন না, নবনির্মিত সংসদ ভবনে প্রবেশ করে প্রধানমন্ত্রী সংবিধানকে সাড়ম্বরে প্রণাম করেন এবং অতঃপর সেই দৃশ্য বহুলপ্রচারিত হয়। অর্থাৎ— দৃশ্যে ও বাস্তবে— বর্তমান জমানায় সংবিধান এ দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুতর বিষয়, রাজনৈতিক বিরোধ ও সংগ্রামের একটি প্রকরণ। সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য এই সংগ্রাম অবশ্যই জরুরি। বস্তুত, তার দায়িত্ব প্রতিটি সুচেতন নাগরিক, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলের। কিন্তু সেখানে দায়িত্ব শেষ হয় না, শুরু হয়। সংবিধানের যথার্থ অনুশীলনও খুব বড় দায়িত্ব। ধারাবাহিক ভাবে সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করলে আপৎকালে তাকে রক্ষা করার কাজটিও সহজতর হতে পারে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য সরব ও সক্রিয়, তাঁরা সংবিধানের নির্দেশ অনুশীলনে কতটা যত্নবান?
বিশেষত, বর্তমান ভারতের বিরোধী রাজনীতিকরা? তাঁরা কি নিজেদের আচরণে সংবিধানের আদর্শগুলিকে পালন করার আন্তরিক চেষ্টা করেন? বিশেষ করে যে সব রাজ্যে তাঁদের হাতে শাসনভার, সেখানে কি তাঁদের কর্মপন্থায় সেই চেষ্টার প্রমাণ মেলে? লঙ্কায় যে যায় সে-ই হয় রাবণ— এমন কোনও অতিসরল প্রবচন আওড়ানো বিধেয় নয়, কিন্তু এ দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের কথায় এবং কাজে দীর্ঘকাল যাবৎ যে মানসিকতা প্রকট হয়ে উঠেছে, তা সংবিধানের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধার পরিচয় দেয় না। অন্য সব প্রসঙ্গ থাকুক, একেবারে গোড়ার কথাটুকুই ধরা যাক। সেখানে বলা আছে যে, জনসাধারণ (‘উই, দ্য পিপল’) নিজেদের জন্য এই সংবিধান ‘রচনা’ করেছে। এই কথাটিই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বীজমন্ত্র। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেই জনসাধারণকে কোন দল কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে থাকে? জনসাধারণের ‘নামে’ নিজেদের আধিপত্য জারি করা এবং জারি রাখাই কি তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় না? এই আধিপত্যবাদ বর্তমান শাসকদের ক্ষেত্রে এক উৎকট আকার ধারণ করেছে, কিন্তু রোগটি কার্যত সর্বদলীয়। দীর্ঘ দিন ধরে এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে এবং তার পরিণামে প্রজার তন্ত্র পর্যবসিত হয়েছে প্রজা শাসনের তন্ত্রে। ৭৫ বছর পরে এই অপ্রিয় সত্যটি স্বীকার করা এবং আত্মসংশোধন করা দরকার, তা না হলে আধিপত্যবাদের কবল থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করা উত্তরোত্তর কঠিনতর হতে বাধ্য।