ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন অনেকেই, কিন্তু রাজ্যের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী সম্ভবত মাছে সন্তুষ্ট হবেন না— তিনি কুমির ধরতে চান। আজ ‘ছাত্র সমাজ’-এর বকলমে যে নবান্ন অভিযান, তাতে পুলিশ যাতে গুলি না চালায়, তিনি সেই বিষয়ে আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। পুলিশকে ভরসা না করার বিস্তর কারণ আছে, আর জি কর-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সেই কারণের সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি— কিন্তু, কোনও একটি বিশেষ মিছিলে পুলিশ গুলি চালাবে, এমন আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তি কী? এখনও অবধি পুলিশ যে ভঙ্গিতে এই আন্দোলন সামলেছে, তাকে ‘কঠোর’ বলা চলে না। ফলে, বিনা প্ররোচনায় পুলিশ আজ নবান্ন অভিযানের উপরে গুলি চালাবে, এ কথার মধ্যে ঘোর অতিরঞ্জন রয়েছে বলেই মনে হয়। এবং, আশঙ্কা হয় যে, এই অতিরঞ্জনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় তো? সংশয় হয়, রাজ্যের বিরোধী নেতা কি তবে একই সঙ্গে পুলিশকে এবং আন্দোলনকারীদের প্ররোচিত করছেন— অশান্তির মাত্রা বাড়িয়ে তোলার জন্য? এই দুর্ভাবনা সত্য না হলেই রাজ্যবাসী আশ্বস্ত হবেন। কারণ, রাজ্যের এক প্রধান বিরোধী নেতা এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করলে তা রাজ্যের পক্ষে বিপুল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু, বাস্তব সেই আশঙ্কাটিকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতেও পারছে না। লক্ষণীয়, পক্ষকালের বেশি সময় ধরে যাঁরা নাগরিক সমাজের আন্দোলনের পুরোভাগে আছেন, ইতিমধ্যেই তাঁদের অনেকে— সামাজিক রাজনৈতিক চালচিত্রের বিভিন্ন পরিসর থেকে— প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে ২৭ তারিখের ‘ছাত্র সমাজ’-এর কর্মসূচি থেকে নিজেদের দূরত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছেন। নাগরিক সমাজের আন্দোলনে বিজেপি যথেষ্ট জমি পায়নি বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। এই অবস্থায় মিছিলের উপরে গুলি চললে রাজনীতিতে গতি আসতে পারে— এই ভয়ঙ্কর ‘আশাবাদ’ দ্বারা কোনও রাজনীতিক চালিত হবেন না, এমন কথা বিশ্বাস করার উপায় দেশের তথা রাজ্যের রাজনীতি অবশিষ্ট রাখেনি। ফলে, অত্যন্ত সাবধান থাকা প্রয়োজন। কোনও প্ররোচনাতেই পা না-দেওয়া পুলিশের অবশ্যকর্তব্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে— এমনকি তাঁরা যদি নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ না-করে কোনও একটি নবনির্মিত ব্যানারের নীচে সংগঠিত হন, তবুও তাঁদের প্রতিবাদের অধিকার অলঙ্ঘ্য। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ-প্রশাসনকে সংযত আচরণ করতে হবে। পুলিশের কর্তব্য, তাঁদের সেই প্রতিবাদ প্রদর্শন করতে দেওয়া, তবে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলার গণ্ডি বজায় রেখে। সেই মিছিলে গুলি চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রেও অতি সতর্ক থাকতে হবে। একটি ভুল পদক্ষেপ যে রাজ্য রাজনীতিকে বিপজ্জনক ভাবে উত্তাল করে তুলতে পারে, সে কথা কখনও বিস্মৃত হওয়া চলবে না।
আর জি কর-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে চলা নাগরিক আন্দোলনে বারে বারেই একটি কথা উঠে এসেছে— যে রাজনৈতিক দল ভিন রাজ্যে বিভিন্ন নারী-নির্যাতনের ঘটনায় নিয়ম করে নির্যাতনে অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ফুল-মালায় বরণ করে নিয়েছে, এই রাজ্যে নারী-অধিকারের আন্দোলনে শরিক হওয়ার অধিকার কি তাদের আছে? এই প্রশ্নটির উত্তর প্রত্যেক নাগরিক নিজের মতো করে খুঁজবেন। কিন্তু, তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যখন ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, সেই মুহূর্তেও এই প্রশ্নটি উঠেছে। বহু সচেতন মানুষ স্পষ্ট ভাবে এই দলের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। রাজ্য রাজনীতির এই চলনটি এক দিকে যেমন আশা জাগায়, অন্য দিকে আশঙ্কাও তৈরি করে— রাজনীতির এই মোক্ষম মুহূর্তটি হাতছাড়া হয়ে যাবে, সেই আশঙ্কায় এই দলটি ভয়ঙ্কর কোনও পথে পা বাড়াবে না তো? শুভেন্দুবাবুর মন্তব্য এই কারণেই অতি উদ্বেগজনক।