হিজাব সংক্রান্ত সমস্যাটি জটিল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার অধিকার বিষয়ক প্রশ্নটি আপাতত প্রশ্নই থেকে গেল। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি দ্বিমত জানানোর ফলে চূড়ান্ত রায় মিলল না, মামলা অতঃপর উচ্চতর বেঞ্চে যাবে। কেউ হিজাব পরতে চাইলে তাঁকে বাধা দেওয়া চলে না— এই অভিমত ব্যাখ্যা করার পরে বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া তাঁর রায়ে মন্তব্য করেছেন: (মীমাংসা) চূড়ান্ত হলে ভাল, কিন্তু ন্যায় আরও ভাল। কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। হিজাব সংক্রান্ত সমস্যাটি জটিল। তার মূল প্রশ্নকে একাধিক দিক থেকে দেখা এবং বিচার করা যায়। বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তের অবস্থান ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ বা অভিজ্ঞান পরিধানের বিরুদ্ধে, তাঁর বক্তব্য: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিসরে তাদের নিজস্ব পোশাক বিধি সবাইকেই মেনে চলতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি এক অর্থে সমতার অনুসারী, যে সমতা (যথেষ্ট কারণ না থাকলে) কোনও বিশেষাধিকারকে মেনে নিতে নারাজ। অন্য দিকে, বিচারপতি ধুলিয়া জোর দিয়েছেন ব্যক্তিস্বাধীনতা বা স্বাধিকারের উপর, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে হিজাব পরা বা না-পরা ব্যক্তিগত পছন্দের প্রশ্ন। সমতা এবং স্বাধিকারের টানাপড়েন চলেছে অন্তত আড়াইশো বছর ধরে— ফরাসি বিপ্লবের কাল থেকে। চূড়ান্ত মীমাংসা দূর অস্ত্।
যথেষ্ট কারণ না থাকলে স্বাধিকার খর্ব করা বিধেয় নয়— এই মূল নীতি যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে তর্কটা দাঁড়ায় ‘যথেষ্ট’ কারণের সংজ্ঞা নিয়ে। যে শিক্ষার্থী বিদ্যায়তনে হিজাব পরে থাকতে চাইছেন তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণের অধিকার হরণ করা হবে কোন যুক্তিতে? ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় চিহ্নের বিরোধ কি তার যথেষ্ট কারণ বলে গণ্য হতে পারে? বিশেষত এই দেশে, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিকে ধর্ম-বিচ্ছিন্নতা থেকে দূরে রাখা হয়েছে? লক্ষণীয়, বিচারপতি গুপ্ত তাঁর রায়ে ফরাসি বিপ্লবের তৃতীয় প্রতিশ্রুতি অর্থাৎ সৌভ্রাত্রের প্রসঙ্গও উত্থাপন করেছেন। তাঁর প্রশ্ন: শিক্ষার্থীরা নিজস্ব ধর্মীয় অভিজ্ঞান সঙ্গে নিয়ে বিদ্যায়তনে গেলে তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক এবং অবাধ সৌভ্রাত্রের বিকাশ ঘটবে কি? মূল্যবান প্রশ্ন, যা আবার জন্ম দেয় একটি প্রতিপ্রশ্নেরও: নিজস্ব অভিজ্ঞান এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়েই তাঁরা সৌভ্রাত্রের অনুশীলন করতে পারেন না কি? বস্তুত, বিভিন্নতা এবং বৈচিত্রকে স্বীকার করে, সম্মান জানিয়ে যে সৌভ্রাত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটতে পারে, সেটাই কি অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও প্রয়োজনীয় নয়, বিশেষত যখন বৈচিত্র এবং নিজস্বতা হরণ করে সবাইকে ক্ষমতা-নির্দেশিত এক ছাঁচে ঢেলে দেওয়ার অভিযান চলছে দুর্বার গতিতে? এবং, শিক্ষাঙ্গনে যদি বিশেষ কোনও ধর্মের অভিজ্ঞানে রাষ্ট্র আপত্তি করতে থাকে, তবে কি সেই আপত্তিটিকে আদৌ সমতার যুক্তিতে সিদ্ধ বলা চলে?
বিচারপতি ধুলিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, হিজাব নিষিদ্ধ করার ফলে ছাত্রীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হলে সেটা কি অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ নয়? অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শিক্ষার অধিকারকে যদি অলঙ্ঘনীয় বলে মেনে নেওয়া হয়, তা হলে কোনও অবস্থাতেই এমন কিছু করা উচিত নয়, যার ফলে সেই অধিকার খর্বিত হয়। উল্টো দিক থেকে কেউ তর্ক তুলতেই পারেন যে, শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া শিক্ষার্থী বা তাঁর পরিবার তথা সমাজেরও দায়িত্ব, তাঁদেরও ‘হিজাব না পরলে ক্লাসে যাব না’ বলে জেদ ধরা উচিত নয়। কথাটা অযৌক্তিক নয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও পরিচালক এবং সরকারের বিশেষ দায় আছে, যা ব্যক্তি বা পরিবারের দায়িত্ব থেকে ভিন্ন মাত্রার। মামলার চূড়ান্ত মীমাংসা বিলম্বিত হওয়ার ফলে সেই দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। কোনও কারণেই এবং কোনও ভাবেই যাতে শিক্ষায় ব্যাঘাত না ঘটে, সেটা শেষ বিচারে সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। সেই বোধ এ দেশের সরকারি কর্তাদের কতটুকু আছে, সেটা অবশ্য কঠিন প্রশ্ন।