পরিবারের লোকেদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘটা বিস্ফোরণে পাথরপ্রতিমায় চলে গিয়েছে আটটি প্রাণ— এমনটাই জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের কর্তা। কথাটি সর্বাংশে সত্য, ঘটনাপরম্পরা তাতে সায় দেবে। বাড়ি থেকে একশো-দেড়শো মিটারের মধ্যেই বাজি কারখানা, বারুদ স্তূপের কাছাকাছি গ্যাস সিলিন্ডারের অবস্থান, রান্নার ব্যবস্থা— এমন সব কিছুই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং বেপরোয়া মনোভাবের পরিচায়ক, যার পরিণামে দু’টি শিশু-সহ একই পরিবারের আট জনের অকালমৃত্যু ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কালে যে পর পর বাজি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রত্যেকটিতে এই আইন অমান্যকারী বেপরোয়া মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু সেগুলিকে কেবল বাজি প্রস্তুতকারক এবং কারখানা মালিকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা বলে দেগে দেওয়া সত্যের অপলাপ। যাঁরা দিনের পর দিন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাজির কারখানা চলতে দেখেও চোখটি বন্ধ করে রইলেন, বছর তিনেক আগে নিষিদ্ধ বাজি-সহ চন্দ্রকান্ত বণিক গ্রেফতার হওয়ার পরও যাঁদের প্রশ্রয়ে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে ফের সেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারলেন, রাজ্যের অন্যত্রও বেআইনি বাজি কারখানাগুলি যাঁদের সক্রিয় সহযোগিতায় চলার ছাড়পত্র পাচ্ছে, সেই ‘তাঁদের’ দায়িত্বজ্ঞানও কি সামান্যতম অবশিষ্ট আছে? বিস্ফোরণে মৃত্যুমিছিল দেখে যাঁরা অন্যের ঘাড়ে দায় ঠেলে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন, বিস্ফোরণের ছাই কি তাঁদের গায়েও লেগে নেই?
এই বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে যে অভিযোগগুলি উঠেছে, সেগুলি গুরুতর এবং প্রতিটি অভিযোগ নিরপেক্ষ তদন্তের আওতায় নিয়ে আসাই হবে ‘রাজধর্ম’ পালন। কেন অভিযুক্তের বাড়িতে পুলিশ, রাজনৈতিক পদাধিকারীরা আসা-যাওয়া করতেন? নিছকই ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কারণে, না কি তাঁদের মধ্যে এক গভীর রাজনৈতিক-আর্থিক গাঁটছড়া বাঁধা ছিল? তাঁরা যদি অভিযুক্তের অতীত এবং বর্তমান কার্যক্রম না জেনেই তাঁর বাড়িতে আনাগোনা করে থাকেন, তবে তাঁদের বোধবুদ্ধি এবং পদাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদান প্রয়োজন। পাথরপ্রতিমা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই বঙ্গে ২০২৩-এর দত্তপুকুরের পর থেকে নিয়মিত ব্যবধানে বাজি বিস্ফোরণের ঘটনা সংবাদে উঠে আসছে। বেআইনি কারখানা বন্ধের হাজার সরকারি প্রতিশ্রুতিও জলে গিয়েছে। সুতরাং, এই কুচক্রের একেবারে গোড়া পর্যন্ত পৌঁছতে না পারলে মৃত্যুমিছিল বন্ধ হবে না। অবশ্য বারুদস্তূপকে অবিলম্বে রাজ্য থেকে সরাতে গেলে পুলিশ-প্রশাসনকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। তা কি আদৌ সম্ভব?
অবশ্য প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন তাঁদের সৎ-সাহস নিয়েও, যাঁরা পাথরপ্রতিমার বারুদ-ঘোলা জলে রাজনীতির মাছ খুঁজতে ব্যস্ত, অথচ নিজ দলের শাসনাধীন রাজ্যে প্রায় একই সময়ে একই ধাঁচের বিস্ফোরণে একুশ জন প্রাণ হারালেও এনআইএ-র দাবি তুলতে হোঁচট খান। যে অনিয়মের অভিযোগে তাঁরা বঙ্গের শাসককুলকে বিদ্ধ করছেন, সেই ধাঁচের অজস্র অনিয়মের অভিযোগ গুজরাতের ডীসা শহরের বাজি কারখানাটির বিরুদ্ধেও উঠেছে। বারুদ নিয়ে কারবার যেখানে, সেখানে প্রশাসনের কঠোর ও নিয়মিত নজরদারি একান্ত আবশ্যক। সামান্যতম অসতর্কতাও বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গেও। গুজরাতেও।