জনসংখ্যা লইয়া চিনের শাসকদের টানাপড়েনের শেষ নাই। গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে ‘জনসম্পদ’ বৃদ্ধির চেষ্টায় দেশবাসীকে সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিয়াছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নায়করা। আশির দশকেই জনবিস্ফোরণ সামলাইতে প্রায় তাঁহারা এক-সন্তান নীতি ঘোষণা করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণের সেই জবরদস্তি দেশে— বিশেষত শহরাঞ্চলে— প্রবল সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করিয়াছিল। তাহাতে পার্টির কঠিন হৃদয় গলিত বলিয়া ভরসা হয় না, কিন্তু বলপূর্বক জনসংখ্যা কমাইবার চেষ্টা দেশের জনবিন্যাসেও গুরুতর গোলযোগ ঘটায়, বিশেষত জনবিন্যাসে বয়স্কদের অনুপাত অতি দ্রুত বাড়ে। ক্রমে বিপদ বুঝিয়া অবস্থা সামাল দিবার তাগিদে শুরু হয় বিপরীত পথে আবর্তন। ছয় বৎসর পূর্বে দুই-সন্তান নীতি গ্রহণ করে চিন। সম্প্রতি তাহা বাড়িয়া তিন হইয়াছে। চিনা মেয়েদের পার্টি বলিয়াছে: তিন সন্তানের জননী হও। শাসকরা অবশ্য দুই বা তিন সন্তান উৎপাদনের হুকুম জারি করেন নাই, তাহার জন্য ‘আহ্বান’ জানাইয়াছেন।
দুই-সন্তান নীতি চিনের জনমানসে তেমন দাগ কাটে নাই। তিন-সন্তান নীতিও দাগ কাটিবে বলিয়া মনে হয় না। তাহার কারণ, এক কথায়, অর্থনীতি। গত তিন দশকে চিনে শিশুদের শিক্ষা এবং বয়স্কদের পরিচর্যা করিবার খরচ বহু গুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে, প্রকট হইয়াছে চিকিৎসা-সহায়ক ব্যবস্থার দুর্বলতা, জাঁকিয়া বসিয়াছে দীর্ঘ সময় কাজ করাইবার সংস্কৃতি। ইহার সহিত রহিয়াছে চিনা সমাজের চিরকালীন লিঙ্গবৈষম্য ও বাজার অর্থনীতির নিজস্ব বাধ্যবাধকতার সমাহারের ফলে এক দিকে, গর্ভবতী নারীদের প্রতি সামাজিক কটাক্ষ এবং অন্য দিকে, কাজের বাজারে তাঁহাদের সুযোগবঞ্চনা। তাহার ফলে, নাগরিকরা স্বাভাবিক ভাবেই এক বা দুইয়ের অধিক সন্তান চাহেন না। শহরে তো নহেই, গ্রামেও সেই না-চাহিবার প্রবণতা দ্রুত বাড়িতেছে। সামাজিক চিন্তার বাতাস স্বভাবত শহর হইতে গ্রাম অভিমুখে যায়— যেমন ভারতে, তেমনই চিনে। বস্তুত, দুনিয়ার সর্বত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই জন্মহার কমিয়াছে। এই প্রক্রিয়ার কোনও ব্যতিক্রম নাই।
এই কারণেই চিনের শাসকরা জনসংখ্যা কমাইবার জন্য এক কালে যে জবরদস্তি করিয়াছেন, তাহা কেবল অন্যায় নহে, নির্বোধও বটে। চার দশক ধরিয়া চিনের নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক বৃদ্ধি এবং নগরায়ণের ফলে সেই দেশে জন্মহার কমিয়া আসিবে, ইহা অবধারিত ছিল। জনসংখ্যা কমাইতে দমনমূলক নীতির কোনও প্রয়োজন ছিল না— অর্থনীতির বৃদ্ধির ফলে তাহাই ঘটিবার ছিল। দমন নীতি সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক বিকৃতি সংযোগ করিয়াছে। আজ তাহার মোকাবিলা করিতে গিয়া পার্টি দুই বা তিন সন্তান উৎপাদনে উৎসাহ দানের যে চেষ্টা করিতেছে, তাহাও প্রগতির চাকা বিপরীত অভিমুখে ঘুরাইবার এক ব্যর্থ চেষ্টামাত্র। এই ভ্রান্তির পিছনেও রহিয়াছে বুদ্ধির অভাব। এই নির্বুদ্ধিতা অতিক্রম করিয়া চিনা শাসকরা যে গভীরতর শিক্ষাটি গ্রহণ করিতে পারিতেন, তাহা গণতন্ত্রকে সম্মান করিবার, নাগরিকের উপর সিদ্ধান্ত চাপাইয়া না দিবার, সহিষ্ণু হইয়া আপনার দায়িত্ব পালন করিবার শিক্ষা। তাঁহারা অবশ্য সেই শিক্ষা লইবার পাত্র নহেন— পার্টি সর্বশক্তিমান, কারণ সে সব জানে।