এক লক্ষ একাত্তর হাজার— ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে এটাই ছিল ভারতে আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা। ২০১৯ সালে এই একই কারণে ভারতে মৃত্যু হয়েছিল এক লক্ষ ঊনচল্লিশ হাজার। অর্থাৎ, ২০১৯ থেকে ২০২২, এই সময়ে দেশে আত্মহত্যার সংখ্যায় ঊর্ধ্বগতিটি লক্ষণীয়। সাধারণত আত্মহত্যার দায় ব্যক্তিবিশেষের উপর চাপিয়ে দোষারোপের প্রবণতাটি সমাজের মজ্জাগত। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এর সঙ্গে যে একাধিক কারণ জড়িত তার মধ্যে আর্থ-সামাজিক কারণটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাই আত্মহত্যার সমস্ত ঘটনাকে মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা অনুচিত। বরং বিচার্য হওয়া প্রয়োজন রাষ্ট্রের আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতি, যা এক লক্ষণীয় সংখ্যক মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই কারণেই দেশে অতিমারি এবং তার অব্যবহিত পরে অর্থনৈতিক সঙ্কট, স্বাস্থ্য বিপর্যয়, জীবিকা ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, শিক্ষাক্ষেত্রের বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল আত্মহত্যার সংখ্যা। আবার তামিলনাড়ুতে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা চালু হওয়ার পরে ২০২২ সালে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ফল প্রকাশ-অন্তে আত্মহত্যা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। সম্প্রতি আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে এক আলোচনা সভায় এই বিষয়গুলির উপরেই জোর দেওয়া হল।
আত্মহত্যা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট পরিবারের ক্ষতি নয়। দেশের উপর এর অর্থনৈতিক অভিঘাতটিও তীব্র। ২০১৯ সালে আত্মহত্যার কারণে দেশে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার কোটি টাকা। সামাজিক কারণের পাশাপাশি এই অর্থনৈতিক কারণেও দেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধ নীতিটি জোরদার হওয়া আবশ্যক। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আত্মহত্যা প্রতিরোধে এক জাতীয় নীতি প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ করা যায়নি। তার একটি কারণ যদি আর্থিক হয়, অন্যটি নিঃসন্দেহে উপযুক্ত তথ্যের অভাব। আত্মহত্যার কারণে মৃত্যুর পাশাপাশি আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনাগুলি প্রায়ই অ-নথিভুক্ত থেকে যাওয়ায় কোন বয়সসীমায়, কোন পেশায়, কোন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে কী কর্মসূচি কার্যকর হবে, তা নির্ধারণ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে, ভারতের মতো দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় এবং সর্ব স্তরের মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা সহজলভ্য না হওয়াও প্রতিরোধ নীতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।
তদুপরি, এই বিষয়টি নিয়ে সর্বস্তরে সংবেদনশীলতার একান্ত অভাব। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এমন ব্যক্তি প্রায়শই চিকিৎসক, পুলিশ, এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান। অথচ, কোন পরিস্থিতি তাঁকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল, তা উপেক্ষিত থেকে যায়। এই মানসিকতা সর্বাগ্রে পরিবর্তন করতে হবে। শুধুমাত্র কিছু ফোন নম্বর, সাহায্যের আশ্বাস প্রদানেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সঙ্কট মুহূর্তে সেই ব্যবস্থাগুলি যাতে নিখুঁত কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। হাসপাতালে ভর্তি হলে আত্মহত্যার চেষ্টা করা মানুষও যাতে অন্য রোগীদের মতোই মনোযোগ পান, নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এবং তথ্যের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। সামনেই পরীক্ষার মরসুম। এই মর্মান্তিক রেখচিত্র যাতে আরও উপরে না ওঠে, সে কাজে এখনই সতর্ক হতে হবে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে