Singer KK Death

মৃত্যুগ্রাস

এই শহরের পক্ষে যা আরও দুঃখের, অধিকতর লজ্জার, তা হল, দেশ জুড়ে প্রশ্ন উঠেছে, কলকাতায় বলেই কি এই ভাবে প্রাণ হারাতে হল শিল্পীকে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২২ ০৪:৫৫
Share:

কলকাতার এক মঞ্চে গান গাইতে গাইতে অসুস্থ হলেন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই মৃত্যু হল তাঁর। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু, এই শহরের পক্ষে যা আরও দুঃখের, অধিকতর লজ্জার, তা হল, দেশ জুড়ে প্রশ্ন উঠেছে, কলকাতায় বলেই কি এই ভাবে প্রাণ হারাতে হল শিল্পীকে? এক জনপ্রিয় শিল্পীর অকালপ্রয়াণে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটা স্বাভাবিক, কিন্তু এই প্রশ্নটিকে কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক আবেগের প্রকাশ বলে উড়িয়ে দিলে ভুল হবে। ভাবা প্রয়োজন, এই শহরের কাঠামোয় এমন কিছু ঘুণপোকা ঢুকে পড়েছে কি না, যা শহরের মূলগত চরিত্রটিকেই পাল্টে দিচ্ছে। খোঁজা দরকার, কোন কোন স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে সেই বিষ। প্রথমেই মনে পড়বে বিশৃঙ্খল নাগরিকদের কথা, যাঁদের কাছে নিজের মর্জিটুকুই সব। প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের পাস থাক বা না-ই থাক, হলে তিলধারণের জায়গাটুকুও না থাক, তাঁরা অনুষ্ঠান দেখতে প্রবেশ করেছেন। অনুমান করা চলে, তাঁদের আচরণ এমনই আগ্রাসী ছিল যে, শরীর খারাপ লাগা সত্ত্বেও অনুষ্ঠান বন্ধ করার কথা বলতে গায়ক নিরাপদ বোধ করেননি— তাঁকে অনুষ্ঠান চালিয়ে যেতে হয়েছে। সে দিন শ্রোতা-দর্শকের সিংহভাগই ছিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। তাঁদের এই অমার্জিত, বিশৃঙ্খল চেহারা সমাজের পক্ষে সুসংবাদ নয়। তাঁদের পিছনেই ছিলেন ইউনিয়নের নেতারা— বছরের পর বছর কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়া সত্ত্বেও যাঁদের অঙ্গুলিনির্দেশে পরিচালিত হয় কলেজের কর্মসূচি। তাঁরাও শিখে নিয়েছেন যে, শক্তি প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ পন্থা বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেওয়া— বস্তুত, শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারলে তবেই তাঁদের জোরের জায়গাটি জনসমক্ষে স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে।

Advertisement

পরবর্তী স্তরে দায় বর্তায় নজরুল মঞ্চের কর্তৃপক্ষের উপর। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের সংখ্যা তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রগুলিও কাজ করেনি। বদ্ধ প্রেক্ষাগৃহে, ধারণক্ষমতার বহু বেশি লোকের উপস্থিতিতে যদি বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাটি কাজ না করে, তবে তা কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে, হল কর্তৃপক্ষ সম্ভবত তা ভেবে দেখেননি। আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য অ্যাম্বুল্যান্স বা জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিল না বলেই অভিযোগ। কর্তব্যবোধ বস্তুটি আজকের বঙ্গদেশে সুলভ নয়, কিন্তু তার এতখানি অভাবও প্রতি দিন চোখে পড়ে না। দায় পুলিশেরও। এই অনুষ্ঠানটি নিয়ে কয়েক দিন ধরেই যে ভাবে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল, তাতে পুলিশের তরফে আরও প্রস্তুতি প্রত্যাশিত ছিল। দুর্জনে বলতে পারে, যে হেতু এই অনুষ্ঠানটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাত্রদের অভিযান ছিল না, ফলে পুলিশও সক্রিয় হওয়ার কথা ভেবে দেখেনি।

যে কারণগুলি একের পর এক সংযুক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত শিল্পীর দুঃখজনক মৃত্যুর পরিণতিতে পৌঁছল, সেগুলি একটি অভিন্ন গ্রন্থিতে বাঁধা। রাজ্যবাসী অভিজ্ঞতায় সেই গ্রন্থিটির সঙ্গে সবিশেষ পরিচিত— তার নাম রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বিনা নির্বাচনে দিনের পর দিন কলেজের ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকা যেমন তার একটি দিক, বিশৃঙ্খলাকেই যুগধর্ম মনে করা অথবা পুলিশ-প্রশাসনের গা-ছাড়া মনোভাব তার অন্য দিক। গোটা (অ)ব্যবস্থাটির পিছনে রয়েছে এক আশ্চর্য প্রশ্রয়ের সংস্কৃতি— ঠিকঠাক রাজনৈতিক ছাতার তলায় থাকতে পারলে কারও কোনও শাস্তি না হওয়ার নিশ্চয়তা। কোনও আচরণের জন্যই কেউ জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। ফলে, প্রত্যেকেই বেলাগাম, উচ্ছৃঙ্খল, ক্ষমতাপ্রমত্ত। সকলেই জানেন যে, প্রশ্ন উঠলে গান স্যালুটের আওয়াজে তাকে চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।

Advertisement

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement