ওপেন বুক এগজ়ামিনেশন বা বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ার কথা শুনলে ভারতের বেশ কিছু রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা হয়তো ঠোঁট উল্টিয়ে বলবে, সে আর নতুন কথা কী! যথাযথ আশীর্বাদী হাত মাথার উপরে থাকলে যে কোনও পরীক্ষাকেই তো ওপেন বুক করে ফেলা যায়। কথাটা যে নেহাত ফেলনা নয়, সে বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের ইদানীং কালের পরীক্ষার্থীরাও সাক্ষী দিতে পারে। তবে, জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের সূত্র মেনে সিবিএসই যে বই খুলে পরীক্ষার কথা বলেছে, তা টুকলির সরকারি ছাড়পত্র নয়— আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত এক পরীক্ষাব্যবস্থা, যেখানে ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থ করবার ক্ষমতা যাচাই করা হয় না; দেখা হয়, অধীত বিষয়গুলি তাদের বোধের অন্তর্গত হয়েছে কি না। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রটি মুখস্থ উগরে দিয়ে সেই পরীক্ষায় পাশ করার উপায় নেই— তার জন্য বুঝতে হবে যে, প্রতিটি ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া বস্তুটি কী; প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তার অর্থ বুঝতে হবে। বই খুলে লেখার এই পরীক্ষাব্যবস্থায় স্বভাবতই এমন প্রশ্ন আসে না, যার উত্তর সরাসরি বইয়ের পাতায় মিলবে। প্রশ্নের যথার্থ উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য অধীত বিদ্যার আলোয় প্রশ্নটিকে বুঝতে হবে প্রথমে। অর্থাৎ, ওপেন বুক এগজ়ামিনেশন একটি ভিন্নতর শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলে, যেখানে পাঠদানের উদ্দেশ্য ভারতের বর্তমান ব্যবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক, পঠনপাঠনের কৌশলও পৃথক। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের উদাহরণ বলবে, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাটি মুখস্থবিদ্যা-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় কার্যকরও বটে। ফলে, অন্তত তাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যবস্থাটির কথা আলোচনায় নিয়ে আসা ভুল নয়।
তবে, প্রশ্ন উঠতে পারে, স্কুলস্তরে বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ার এই নীতিটি কি আদৌ ফলপ্রসূ হবে? ভারতের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাকে মাপকাঠি ধরলে এই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দেওয়া মুশকিল। এক দশক আগে সিবিএসই ওপেন টেক্সট বেসড অ্যাসেসমেন্ট (ওটিবিএ) নামক একটি ব্যবস্থা চালু করেছিল, চরিত্রগত ভাবে যা ওপেন বুক এগজ়ামিনেশনের সমতুল। কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবস্থাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, কারণ সেই পরীক্ষাব্যবস্থায় অভীষ্ট ‘বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাশক্তির বিকাশ’ ঘটছিল না। ২০২১ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন বুক এগজ়ামিনেশনের উপরে হওয়া একটি সমীক্ষাতেও দেখা যায় যে, তার জন্য যে ভাবে পড়ানো প্রয়োজন, শিক্ষকরা তা পারছেন না। অন্য একাধিক সমীক্ষার ফলাফলও একই অভিমুখ নির্দেশ করেছিল। অর্থাৎ, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার কোনও স্তরেই শিক্ষকরা এই নতুন গোত্রের পাঠদান প্রক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট তৈরি নন, এমন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসঙ্গত হবে না। কাজেই, পরীক্ষাব্যবস্থাটি চাপিয়ে দেওয়ার বদলে শিক্ষকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ ইত্যাদির উপরে জোর দিলে কাজের কাজ হত। কিন্তু, তার চেয়েও একটি বড় এবং প্রকটতর সমস্যা রয়েছে। দেশের বহু রাজ্যেই শিক্ষাব্যবস্থার এমন হাল যে, ছাত্ররা পরীক্ষায় টুকলি করাকে প্রায় সংবিধানসিদ্ধ অধিকার হিসাবে ধরে নিয়েছে। এবং, এই অবস্থা শুধু ‘বিমারু’ রাজ্যগুলিতে নয়, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও দুঃখজনক ভাবে পরিস্থিতিটি খুব পৃথক নয়। এই অবস্থায় ওপেন বুক এগজ়ামিনেশন চালু হলে যে বিচিত্র এবং বীভৎস বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, তা ভাবলেও শিহরিত হতে হয়।
সর্বনাশের পথটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদিচ্ছা দিয়ে বাঁধানো থাকে, এই প্রবাদবাক্যটি বিশ্লেষণ করলে আসলে একটি প্রক্রিয়ার সন্ধান পাওয়া যায়— অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত অন্যদের প্রণোদনার বিচার না করেই কোনও একটি দৈবী অনুপ্রেরণার দ্বারা চালিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। আশঙ্কা হয়, ওপেন বুক এগজ়ামিনেশনের ক্ষেত্রে সিবিএসই ফের সেই ভুলটিই করছে। অবশ্য, এই প্রবণতাটি এক অর্থে বৈশ্বিক। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু তাঁর বই রিজ়ন টু বি হ্যাপি-তে দ্বন্দ্বতত্ত্বের তাত্ত্বিক কাঠামো অনুসরণ করে আলোচনা করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়েও কী ভাবে নিখাদ সদিচ্ছা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও ক্ষতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। যে কোনও প্রশ্নেই সুবিবেচনার চরিত্রলক্ষণ হল, কোনও সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিকর ঘটনাটি কী ঘটতে পারে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা। বোঝার চেষ্টা করা, বর্তমান ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত থাকলে সর্বাধিক যে ক্ষতি ঘটতে পারে, তার চেয়ে সেই নতুন ক্ষতি মারাত্মকতর কি না। সিবিএসই বা জাতীয় শিক্ষানীতি আলোচ্য সিদ্ধান্তটির ক্ষেত্রে তেমন বিশ্লেষণ করেছে কি?