ফাইল চিত্র।
কেহ পথের ধারে পড়িয়া রহিয়াছেন, কেহ বা পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন, কাহারও সকল প্রিয়জন প্রাণ হারাইয়াছেন। যুদ্ধমাত্রেই এবংবিধ মানবিক সঙ্কটের ছবি ফুটিয়া উঠে, কেবল তাহার মাত্রাটির হেরফের ঘটে। ইউক্রেনে যাহা ঘটিতেছে তাহা অতি ভয়ানক, দুই সপ্তাহে ঘর হারাইয়াছেন ২২ লক্ষ মানুষ, রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থার প্রধান যাহাকে ‘ভয়ঙ্কর মাইলফলক’ বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন। হিসাব বলিতেছে, রুশ আক্রমণের পূর্বে ইউক্রেন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় মোট ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ বাস করিতেন, এক্ষণে তাহার ছয় শতাংশ গৃহহারা, হয় দেশ ছাড়িয়াছেন নতুবা দেশের ভিতরেই অন্যত্র আশ্রয়প্রার্থী। ইউক্রেনত্যাগী বিদেশি নাগরিকের সংখ্যাও এক লক্ষ পার করিয়াছে। একুশ শতকে এই মাত্রায় উদ্বাস্তুস্রোত বিশ্ববাসী দেখে নাই, বস্তুত ১৯৯০-এর দশকের যুগোস্লাভ যুদ্ধ ব্যতিরেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সঙ্কট ইউরোপবাসীর নিকট অদৃষ্টপূর্ব। ইহা কত দূর ব্যতিক্রম— রাষ্ট্রপুঞ্জের ভাষায় ‘ফেনোমেনাল’— তাহা মানবাধিকার সংস্থাসমূহের রিপোর্ট দেখিলেই স্পষ্ট হইবে।
এই শতকে উদ্বাস্তুসঙ্কট অভূতপূর্ব রূপ লইয়াছে। শতকের শুরুতেও পরিসংখ্যান ছিল মিনিটে ছয় জন মানুষের ঘর হারাইবার, এক দশক পার করিয়া তাহা গড়ে চব্বিশে দাঁড়াইয়াছে। বর্তমানে ছয় কোটিরও অধিক মানুষ গৃহহারা, বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কালে ইহাই সর্ববৃহৎ মাপের মানবিক সঙ্কট। এই শতকের ছয়টি যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ বা অর্থনৈতিক সঙ্কটে— ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ভেনেজ়ুয়েলা, মায়ানমার— উদ্বাস্তুসংখ্যা দুই কোটির কাছাকাছি। প্যালেস্তাইন বা সোমালিয়ার দীর্ঘ সমস্যা তো আছেই। এই বিপদ লইয়া চিন্তিত বিবিধ সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদ্যাচর্চার নানা ধারাও তাহা লইয়া গবেষণা ও সমীক্ষায় রত। তবু তন্মধ্যেই নূতন যুদ্ধ আসিয়া হাজির, আরও মানুষ মাথার উপর ছাদ হারাইতেছেন, অনিশ্চিত জীবনে তলাইয়া যাইতেছেন। বিংশ হইতে একবিংশ শতকে আসিয়াও মানবসভ্যতা যাহা শিখে নাই— তাহার নাম সভ্যতা।
সম্ভবত ইহার কারণ, কূটনীতি এবং রাজনীতির কৌশলগত দিক লইয়া যত বিশ্লেষণ হয়, মানবিক ক্লেশের সম্ভাবনা ও বাস্তব লইয়া ততখানি হয় না। বরং তাহাকে ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ বা সমান্তরাল ক্ষতি ভাবিয়া নিশ্চিন্ত থাকিবার অভ্যাসটি উত্তরোত্তর ‘স্বাভাবিক’ হইতেছে। গবেষণা বলিতেছে, মানুষের ছিন্নমূল হইবার সহিত অস্ত্রব্যবসার লাভটি সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় সীমান্তরক্ষায় যাহারা চুক্তিবদ্ধ, তাহাদের অধিকাংশই বৃহৎ মাপের অস্ত্রবিক্রেতা সংস্থা। যাহাদের জন্য উদ্বাস্তুসঙ্কটের জন্ম, তাহারাই আবার উহার ফলাফল হইতে সর্বাধিক লাভবান, সংঘর্ষের কারণ বুঝিতেও তাই তেমন বেগ পাইতে হয় না। যে সকল গবেষণা এই জটিল হিসাবনিকাশগুলি তুলিয়া আনিতেছে, তাহারাই হয়তো বলিবে, মানুষের বিপদও তাহাতে ‘সমান্তরাল’ না হইয়া ‘প্রধান’ হয় সে দিকে অগ্রসর হইবার পথটি কোন দিকে। মুশকিল হইল, নেতারা যদি রাজনৈতিক ভাবে সমাজের কাছে উত্তরোত্তর কম দায়বদ্ধ বোধ করেন, তবে এই পথ গ্রহণ করিবার কথা তাঁহারা ভাবিবেন কেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন আবারও এই মৌলিক সঙ্কটটি স্মরণ করাইয়া দিলেন।