দুর্জনের ছলের অভাব হয় না: প্রবাদবচন। তেমনই একটা ছল হল কোনও একটা ধারণাকে বেছে নিয়ে, তাকে প্রতিষ্ঠা দিতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়া। এখন যাখালি চোখে দেখা যাচ্ছে মসজিদ, সুদূর অতীতে তা ছিল মন্দির— এ-হেন প্রচার এখন তেমনই এক ছল, যেমন হল সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে। কয়েকশো বছরের প্রাচীন, ভারত সরকারের নথিতে ‘ন্যাশনাল মনুমেন্ট’ হিসাবে স্বীকৃত সম্ভল শাহি জামা মসজিদ আসলে দূরতর অতীতের হরিহর মন্দির— এই দাবি নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে স্থানীয় নিম্ন আদালতে। মামলা দায়েরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আশ্চর্য দ্রুততায় কমিশনার নিয়োগ করে মসজিদে সমীক্ষাও হয়েছে, তা ঘিরে পরে অশান্তিতে প্রাণও গিয়েছে কয়েক জনের। অতঃপর সুপ্রিম কোর্টে মসজিদ কমিটির আবেদনের ভিত্তিতে সমীক্ষায় স্থগিতাদেশ এসেছে, সঙ্গে নানা নির্দেশ: মসজিদ চত্বরে যেটুকু সমীক্ষা হয়েছে তা মুখবন্ধ খামে আদালতে জমা দিতে হবে, সমীক্ষার রিপোর্ট আগামী ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসবে না, এই সময়ের মধ্যে মসজিদ কমিটিকে ইলাহাবাদ হাই কোর্টে আবেদন করতে হবে, হাই কোর্টকেও সমীক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশ দিতে হবে, ইত্যাদি।
একদা যে পথে হেঁটেছে রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ, এখনও হাঁটছে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি-শাহি ইদগা বা মধ্যপ্রদেশের কামাল-মওলা মসজিদ, সম্ভলও হয়তো সেই পথেই এসে পড়ল— এমন ধন্দ জাগা অমূলক নয়। মসজিদের জায়গায় এক সময় মন্দির ছিল অতএব তা ফেরত দিতে হবে, এই ধুয়ো তুলে আদালতে এক বার মামলাটি করে ফেলতে পারলেই হল, আইন-আদালতের জটিল প্রক্রিয়ায় একটা লম্বা সময় কেটে যাবে, এবং গোটা সময়টা জুড়ে এই বিষয়কেই করে তোলা হবে রাজনীতির অস্ত্র; ক্রমাগত তাকে জিইয়ে রেখে, সময়ে সময়ে তুলে দেখানো হবে গল্পের কুমিরছানার মতো। এ আসলে এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প, যার ভিত্তিই হল হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ। মন্দির ও মসজিদকে আদালতে লড়িয়ে দেওয়া, বিষয়টিকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে জনজীবন ও সমাজমাধ্যমকেও অশান্ত করে তোলা এই বিভাজনতন্ত্রের পরিকল্পিত কৌশল। ‘মন্দির ওয়হি বনায়েঙ্গে’ স্লোগান কোন পথে বাস্তবায়িত হয়েছে সেই উদাহরণ চোখের সামনে, এখন কি তালিকা ধরে ধরে বাকিগুলির পালা?
এই প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে যে কোনও কিছুই বরদাস্ত করা হবে না সেই ইঙ্গিতও এরই মধ্যে স্পষ্ট। মসজিদ যতই ‘জাতীয় সম্পদ’ হোক, প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্য-নিদর্শন হোক, এই সব পরিচয় ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হচ্ছে না— তার প্রথম ও শেষ পরিচয় তা মসজিদ। সম্ভল-কাণ্ডে মসজিদ কমিটি তুলেছে ১৯৯১-এর উপাসনাস্থল (বিশেষ ব্যবস্থা) আইনের সঙ্গত প্রশ্নটিও— যে আইন অনুযায়ী কোনও মন্দির-মসজিদের চরিত্র পাল্টানোর কথা নয়, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সময় যেখানে যেমনটি ছিল তেমনই রাখতে হবে— শুধু রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ ছিল এর বাইরে। আইনের কথাই যদি বলা হয় তা হলে সম্ভলেও কোনও সমীক্ষা হওয়ার কথা নয়, তবু তা হয়েছে, হয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততা ও সক্রিয়তায়। সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার কারণ তাই যথেষ্ট। স্রেফ মসজিদ ভাঙার আশঙ্কা নয়— ভারতের সংবিধান যাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে সেই ধর্মনিরপেক্ষতাই ভাঙনের মুখে কি না, ভয় সেখানেই।