ইউএপিএ-র ধারায় অভিযুক্ত বিহারের এক বাসিন্দাকে জামিন দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলল, অপরাধ যতই গুরুতর হোক, জামিনের সপক্ষে যদি যুক্তি থাকে, তা হলে অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়াই আদালতের কর্তব্য। এই পর্যবেক্ষণটি একাধিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি আদালতের ভিতরে ও বাইরে শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা জামিন দানের সপক্ষে বার বার কথা বলেছেন। মুক্তি যে প্রতিটি ভারতীয়ের সাংবিধানিক অধিকার, বিশেষ কারণ না ঘটলে কাউকে বন্দি করে রাখা চলে না, এ কথা মনে করিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি নিম্ন আদালতগুলিকে মনে করিয়েছেন, সমালোচিত হওয়ার ভয়ে জামিনের আবেদন বাতিল করা অনুচিত। জঘন্যতম কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে, তিনিও জামিন পেতে পারেন, যদি তিনি আদালতের কাছে জামিনের সপক্ষে যথাযথ যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের এই কথাটি যে কোনও অপরাধের বিচারেই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ধারা ইউএপিএ-র মামলাগুলির ক্ষেত্রে এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বার বার অভিযোগ উঠছে, সন্ত্রাসবাদ দমনের ইউএপিএ-র ধারা প্রয়োগ করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের উদ্দেশ্যে। যে-হেতু এই ধারায় জামিন পাওয়া কঠিন, তাই ইউএপিএ প্রয়োগ করলে অভিযুক্তকে দীর্ঘ দিন জেলবন্দি করে রাখা যায়। অতএব, সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে ইউএপিএ-র ধারায় বন্দি বিচারাধীন ব্যক্তিরা আশ্বস্ত হবেন। পাশাপাশি, বিরুদ্ধ-স্বরকে দমন করতে এই আইনের অপব্যবহারের প্রবণতাও কমবে বলে আশা।
আইনের শাসন যদি যথাযথ হয়, তা হলে ইউএপিএ প্রয়োগই হওয়ার কথা অতি সতর্কতার সঙ্গে, অতি সামান্য ক্ষেত্রে। কার্যত দেখা গিয়েছে, ইউএপিএ প্রয়োগ করে তিন বছরে (২০১৮-২০) গ্রেফতার হয়েছিলেন ৪৬৯০ জন ব্যক্তি, দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তাঁদের মাত্র তিন শতাংশ। কিন্তু আইনের ধারা এমনই কঠোর যে, অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই দীর্ঘ দিন কারাবন্দি ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য ভীমা কোরেগাঁও মামলায় (২০১৮) গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেককেই জামিন দিয়েছে। এঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, একাদিক্রমে চার-পাঁচ বছর বন্দি রাখার পরেও পুলিশ তাঁদের অভিযোগের সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আদালতে পেশ করতে পারেনি। সাম্প্রতিক ঘটনায় বিহারের একটি মামলা উঠেছিল শীর্ষ আদালতে, যেখানে জামিনের আবেদনকারী ব্যক্তি একটি বাড়ির মালিক। তিনি বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন এক ব্যক্তিকে, যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কাজের ষড়যন্ত্র করছিল বলে মনে করছে পুলিশ। শীর্ষ আদালত আবেদন মঞ্জুর করে বলে, ভাড়াটে কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তা বাড়িওয়ালা জানতেন, এমন প্রমাণ নেই। সংগঠনটিও সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষিত সংগঠনগুলির তালিকায় নেই। অতএব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে বাড়িওয়ালার সংযোগের প্রমাণ মেলেনি।
লক্ষণীয় এই যে, সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আবেদনের আগে ওই বাড়িওয়ালা ব্যক্তি নিম্ন আদালতে এবং পটনা হাই কোর্টে জামিন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় একাধিক বার যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, এ ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে কি না, কারও মনে সে প্রশ্ন উঠতে পারে— অর্থাৎ, জামিনের আবেদনের ঔচিত্যের চেয়ে অপরাধের গুরুত্বই কি অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে নিম্নতর আদালতে? সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু প্রথমটিকেই অধিক গুরুত্ব দিল। এটা কেবল ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা নয়, ভারত নামক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রেরও প্রতিষ্ঠা করল। ভারতকে ‘পুলিশ রাষ্ট্র’ করে তোলার যে রাজনৈতিক চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে ভীতিপ্রদর্শন করে বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার, ভুয়ো অভিযোগে গ্রেফতার করে চলাফেরার স্বাধীনতা খর্ব করার যে প্রবণতা সর্বস্তরের সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, শীর্ষ আদালত সে সম্পর্কে বার বার সতর্ক করছে। শাসকদের কবে বোধোদয় হবে?