Women And Children

সুরক্ষার কাঠামো

ন্যায় বিচারের পরিকাঠামো তৈরি না করে কেবলই ধর্ষণে অভিযুক্তের আরও কঠোর সাজা দাবি করা অর্থহীন। অথচ, সেই প্রাথমিক কাজে ফাঁক থেকে গিয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৪৪
Share:

বার বার তাগাদা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার মহিলাদের সহায়তার জন্য নিবেদিত বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর (১৮১) চালু করেনি। মহিলা ও শিশুদের উপর নির্যাতনের প্রতিকারে বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক আদালত শুরু করেছে অনেক বিলম্বে, অতি অল্প সংখ্যায়। কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের এই তথ্যগুলি উদ্বেগজনক। আর জি কর-কাণ্ডের পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী যে আরও কঠোর আইন ও কঠিন শাস্তির দাবি তুলছেন, তা কি এই বিচ্যুতিগুলি থেকে নজর ঘোরাতে? আইন কঠোর করার প্রস্তাব দিয়ে যে চিঠি মমতা কেন্দ্রকে পাঠিয়েছিলেন, তার জবাবি চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, যৌন হিংসা প্রতিরোধের পরিকাঠামো নির্মাণে পশ্চিমবঙ্গের বিলম্ব ও বিচ্যুতি, দু’টিই ঘটেছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রাণদণ্ডের মতো তীব্র শাস্তির ব্যবস্থা ধর্ষকদের প্রতিহত করবে, এমন আশা করা সমীচীন নয়। যা অপরাধের প্রবণতা কমায়, তা হল পুলিশের তৎপরতা, শাস্তির নিশ্চয়তা। মেয়েদের অভিযোগকে গুরুত্ব দান, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলির নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, ধর্ষণের যথাযথ তদন্ত এবং আদালতের দ্রুত বিচার— এগুলিই দুষ্কৃতীদের সংযত হতে বাধ্য করে। সর্বাধিক জরুরি অপরাধীকে নিবৃত্ত করা। তার জন্য পুলিশ, প্রশাসন ও অসরকারি নানা পরিষেবার একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। যথাযথ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, তার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ, এবং দক্ষ কর্মী নিয়োগ করা প্রয়োজন। এটাই সরকারের কাজ। অপরাধীর কত দিনের মধ্যে সাজা হওয়া দরকার, কী সাজা হওয়া দরকার, তা নির্ধারণ করার আইন রয়েছে, আদালতের প্রজ্ঞাও রয়েছে। আইনে ঘাটতি নেই, ঘাটতি পরিকাঠামোর।

Advertisement

ন্যায় বিচারের পরিকাঠামো তৈরি না করে কেবলই ধর্ষণে অভিযুক্তের আরও কঠোর সাজা দাবি করা অর্থহীন। অথচ, সেই প্রাথমিক কাজে ফাঁক থেকে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার পোষিত একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালে ফাস্ট ট্র্যাক আদালত, এবং বিশেষ ভাবে শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের (পকসো) বিচারের জন্য বিশেষ আদালত নির্মাণের কাজ শুরু হয়। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের নির্দেশ ছিল, ২০১৫-২০ সালের মধ্যে সারা দেশে আঠারোশো ফাস্ট ট্র্যাক আদালত তৈরি করবে রাজ্যগুলি, হাই কোর্টের পরামর্শ নিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকার এ জন্য নির্ভয়া তহবিল থেকে কিছু বরাদ্দও করেছিল। এই প্রকল্পের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ১২৩টি ফাস্ট ট্র্যাক আদালত নির্মাণ ধার্য করা হয়েছিল, যার মধ্যে ধার্য ছিল কেবল পকসো মামলাগুলির জন্য কুড়িটি বিশেষ আদালত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এই প্রকল্পে যোগদানের সম্মতি দিয়ে কেন্দ্রকে প্রথম চিঠি পাঠায় গত বছর, কেবলমাত্র সাতটি পকসো আদালত শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সংশোধিত লক্ষ্য অনুসারে রাজ্যকে ১৭টি ফাস্ট ট্র্যাক আদালত মঞ্জুর করা হলেও, এ বছর জুন মাস পর্যন্ত কেবল ছ’টি পকসো আদালত শুরু হয়েছে, আরও এগারোটির কাজ শুরুই হয়নি।

ধর্ষণ ও পকসো মামলা মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আটচল্লিশ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ কথাও ভোলা চলে না যে, যে কোনও রাজ্যের মতো, এখানেও প্রকৃতপক্ষে যত নিগ্রহ ঘটে, তার অতি সামান্যই পুলিশের খাতায় লেখা হয়। আইন প্রণয়নের দশ বছর পরেও অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে এখনও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি তৈরি হয়নি। যেখানে হয়েছে সেখানেও প্রায়ই তা রয়েছে খাতায়-কলমে। অসংগঠিত মহিলাদের জন্য জেলায় জেলায় গঠিত ‘লোকাল কমিটি’র অবস্থাও তথৈবচ। মহিলা থানা, মহিলা আদালতগুলির কার্যকারিতা কতখানি, তার মূল্যায়ন হয়নি। কর্মরত মহিলাদের হস্টেল, জরুরি প্রয়োজনে রাতে থাকার মতো আবাস, নিগৃহীত মহিলাদের সহায়তা, এ সব ব্যবস্থার সামান্যই হয়েছে। অপরাধ প্রতিরোধে এত ফাঁক রেখে দ্রুত বিচার, কঠোর শাস্তির দাবি গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার শামিল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement