কিছু পরিবর্তন, কিছু অপরিবর্তনীয়। নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পরেই পশ্চিমবঙ্গে যথারীতি শুরু হয়েছে প্রতিহিংসার তাণ্ডব। ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ, প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আস্ফালন, বিপক্ষকে মারধর, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, হুমকি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে বিরোধী দলগুলি তাদের কর্মীদের জন্য হেল্পলাইন, আশ্রয় শিবির প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে। এই পরিস্থিতি প্রশাসনের ব্যর্থতারই সাক্ষ্য দেয়। ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। অতীতে দেখা গিয়েছে, লোকসভা, বিধানসভা বা পঞ্চায়েত, প্রতিটি নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি হয়েছে বাংলায়। বার বার ব্যাপক হারে বিপক্ষের কর্মীদের ঘরছাড়া, এলাকাছাড়া করতে পারে এলাকার বিজয়ী দল। নির্বাচনের পর হিংসা চলবে, তা ধরে নিয়েই চারশো কোম্পানি কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পশ্চিমবঙ্গে মোতায়েন রয়েছে ১৯ জুন অবধি। তাতে হিংসায় রাশ টানা গেল না, তা দেখাই যাচ্ছে। ১ জুন নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দিন থেকেই সংবাদে প্রকাশিত হচ্ছে নানা জেলায় রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিবরণ। নদিয়ার কালীগঞ্জ এবং কলকাতার সোনারপুর অঞ্চলে দুই ব্যক্তিকে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় দলীয় বিরোধিতা, বা দলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বকেই দায়ী করছেন এলাকার মানুষ। বিরোধী দলগুলির কর্মীদের বিরুদ্ধেও অবশ্য হিংসার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষত বিজেপি যে সব এলাকায় প্রভাবশালী, সেই কোচবিহার ও মেদিনীপুরে বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে হিংসা ও প্রকাশ্যে ভীতিপ্রদর্শনের অভিযোগ এসেছে পুলিশের কাছে।
প্রত্যন্ত এলাকার পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। কিন্তু কেবল শহরতলি আর গ্রামাঞ্চল নয়, খাস কলকাতায় বাড়ি থেকে বেরোলে খুনের হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটছে, মারধরের পর পুলিশে জেনারেল ডায়েরি করা হচ্ছে অগণিত। মারধর, আক্রমণ চলছে মেয়েদের উপরেও— বারুইপুর এবং পাথরপ্রতিমা থেকে বিজেপির বহু মহিলা-কর্মীর ঘরছাড়া হওয়ার সংবাদ আসছে। কলকাতার বেলেঘাটা, ট্যাংরা, যাদবপুর, আলিপুরে শনিবার ভোট শেষের পর থেকেই বাড়ি ভাঙচুর, হুমকির অভিযোগ দায়ের করেছেন অনেকেই। নিরন্তর হিংসার যত ছবি সামনে আসছে, তার থেকে বেশি অজানা থাকছে, তা-ও আন্দাজ করা কঠিন নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন সমাধা হওয়ার পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গে ৮৫২টি হিংসার ঘটনা ঘটে, আহতের সংখ্যা ছিল দেড় হাজারেরও বেশি। এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী, সে বছর রাজনৈতিক খুনের তালিকায় বাংলা শীর্ষে ছিল। প্রতিটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার ব্যাপকতা ও প্রাণহানির সংখ্যা রাজ্যে আতঙ্ক তৈরি করে। এই পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতির কোনও পথ দেখা যাচ্ছে না।
শাসক দলের মুখপাত্ররা অভিযোগ অস্বীকার করলেও, শাসক দল তথা প্রশাসন কখনওই এই উন্মত্ত হিংসা ঘটতে দেওয়ার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। বিভিন্ন দলের নেতারা যতই কর্মীদের রক্ষা করতে উদ্যোগী হোন, দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ করতে শেষ অবধি পুলিশের সহায়তার উপরেই ভরসা করতে হচ্ছে। আর গলদ বরাবরই গোড়ায়— পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন শেষ হওয়ার নয়। অভিযোগ উঠেছে, আক্রান্ত কংগ্রেস কর্মীরা থানায় গেলে পুলিশ তাঁদেরই গ্রেফতার করেছে। পুলিশ-প্রশাসনের এই ভূমিকার খেসারত রাজ্যবাসী দিচ্ছে তিন ভাবে। এক, প্রাণ ও সম্পদের মূল্যে। দুই, অর্থমূল্যে— রাজকোষের টাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর খরচ জুগিয়ে। সর্বোপরি, আস্থার মূল্যে। বিরোধীকে কুপিয়ে মারাই যদি ভোটে জেতার কৌশল হয়, তা হলে ইভিএম-এর প্রয়োজন কী? লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি রাজ্যের মানুষ যে বিপুল আস্থা দেখিয়েছে, তার প্রতি যদি মমতার কিছুমাত্র শ্রদ্ধা থাকে, তা হলে এখনই এই রক্তক্ষয় বন্ধ করতে সক্রিয় হোক তাঁর সরকার।