এক-একটি ঘটনা অনেক সময়ে অনেক ধোঁয়া কাটিয়ে দেয়। পহেলগাম সন্ত্রাস তেমনই ভারতীয় কূটনীতিতে একটি হিমালয়সমান চ্যালেঞ্জকে বেআব্রু করে দিয়েছে। কত বড় সেই চ্যালেঞ্জ, সেটা বোঝার সহজতম উপায় হয়তো বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমের এক বিরাট অংশে কী ভাবে কাশ্মীরে জঙ্গি হানা ও তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ বিবৃত হচ্ছে, তা দেখা। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে যে ভাষা ও বয়ান রাখা হয়েছে, তার মধ্যে ইসলামাবাদের ‘সাফল্য’ দেখে পাকিস্তান সন্তুষ্ট, আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের সিংহভাগ অতীব প্রসন্ন। অন্যান্য দিক থেকেও ঢাকার সংবাদ উদ্বেগজনক। সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি উপদেষ্টা কাশ্মীর-হানার পর দিনই বাংলাদেশের জঙ্গি নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক এখন আগের চেয়ে অনেক নিকট এবং গভীর, তদুপরি ঢাকায় বর্তমান সরকারের আমলে মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে ভারত সরকার ইতিমধ্যেই অবহিত। ফলে এক দিকে জঙ্গি হানা, অন্য দিকে পূর্ব ও পশ্চিমে যুগপৎ শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশ নিয়ে এই মুহূর্তে ভারত বড় বিপদের সম্মুখীন। এই পরিস্থিতিতে পহেলগাম ঘটনার পর তীব্র জনাবেগ সামলাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর প্রত্যাঘাত বা যুদ্ধের কথা দিল্লিতে ভাসলেও ভারত সরকারের পক্ষে যোগ্য উত্তর খোঁজার কাজটি বেশ কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর ‘মন কি বাত’ বক্তব্যে দৃপ্তকণ্ঠে হামলাকারীদের ‘কল্পনাতীত শাস্তি’ দেওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু এড়িয়ে গিয়েছেন প্রতিবেশী দেশটির নাম, যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজেপি-প্রভাবিত সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম গত কয়েক দিন যাবৎ উচ্চরবে আক্রমণ শাণিয়ে চলেছে।
ভারত পাকিস্তান, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংঘাতপূর্ণ আবহ তাদের জন্মের পরমুহূর্ত থেকে প্রত্যহ অব্যাহত। তবে এখনকার ভারতের নতুন বিপদ এই শত্রুপরিবৃত প্রতিবেশী কূটনৈতিক বলয়। বাংলাদেশের গত অগস্টের অভ্যুত্থান-পরবর্তী চরম ভারতবিরোধিতার পরিবেশের সঙ্গে রয়েছে পাকিস্তানের প্রতি চিন ও তুরস্কের অবারিত সমর্থন। পহেলগাম ঘটনায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তান যে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছে, তাতে চিন গলা মিলিয়েছে ইতিমধ্যেই। পাকিস্তানের সামরিক ক্ষমতার পিছনেও বেজিং ও ইস্তানবুলের সক্রিয় সমর্থন, ঢালাও কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত সরবরাহ— সাউথ ব্লক যথেষ্ট অবহিত। আর চিন-প্রভাবিত ছোট দেশগুলিকে মাথায় রাখলে সহজেই বোঝা যায় যে ভারত এই মুহূর্তে কী ভাবে একটি পূর্ণ শত্রুবলয়ের মধ্যে আবদ্ধ।
ভূরাজনৈতিক বিপন্নতার এই মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকাটি বিশেষ গুরুত্বময়। বাংলাদেশের সীমান্ত অনেকটাই অরক্ষিত, কিয়দংশে কাঁটাতারহীন, কিয়দংশে নদীপথ-সম্বলিত। ইতিমধ্যেই এই অনিরাপদ সীমান্তে আধা-সামরিক বাহিনী ও সেনা-গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে। মুর্শিদাবাদ ঘটনার সময়েই কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসেছিল, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। কাশ্মীর ঘটনা সেই তৎপরতাকে অনেক গুণ জরুরি করে দিয়েছে। তবে কিনা, পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ও জঙ্গি গতিবিধি রোখার প্রশ্নে যে সব চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে— পূর্ব সীমান্তরেখা বরাবরও সেই উদ্বেগ কাটানো সহজ হবে না। তবে একটি কথা সব রাজনৈতিক পক্ষকেই মনে রাখতে হবে— কেন্দ্রে, রাজ্যে, সর্বত্র— কেবল সীমান্তের প্রতিরক্ষাতেই সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না, দুই সম্প্রদায়ের মিলিত বাস যে রাজ্যে সেখানকার সমাজে ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও সংঘাত বাড়লে বজ্র আঁটুনির নিরাপত্তাতেও ফস্কা গেরো বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে কথা মনে রেখে রাজ্য রাজনীতির নেতারা দায়িত্বসহকারে বিচরণ করুন, কথাবার্তা বলুন— এই দায়িত্ববোধ এখন অত্যন্ত জরুরি। কেবল রাজ্যের স্বার্থে নয়, সমগ্র দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে