৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লায় প্রধানমন্ত্রী।
লাল কেল্লায় ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণটি ভিন্ন রকম। সংবাদে প্রকাশ, টেলিপ্রম্পটার দেখে নয়, প্রধানমন্ত্রী নাকি ভাষণটি দিয়েছেন মন থেকে। তবে, ভিন্নতার সূচনা ও সমাপ্তি সেখানেই— ৮২ মিনিটের ভাষণটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অন্য ভাষণের আর কোনও ফারাক আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। ভাষণে ভাল ভাল কথা বলাই দস্তুর। তিনি শততম স্বাধীনতা দিবসের আগে ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করার সঙ্কল্প ঘোষণা করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। প্রসঙ্গত কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটিকে কি রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে রাখা যেত না? কিন্তু, ক্ষুদ্রতা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার যে সাধনা, তা নরেন্দ্র মোদীর নয়— অন্তত, তেমন কোনও নজির গত আট বছরে মেলেনি। অতএব, তিনি যা বলেছেন, সে দিকেই নজর দেওয়া বিধেয়— কোন কথাটি না বললে ভাল হত, সে দীর্ঘশ্বাস গণতন্ত্রের অন্যতর সুদিনের জন্য তোলা থাকুক।
প্রধানমন্ত্রী আগামী পঁচিশ বছরের জন্য যে লক্ষ্যের কথা শুনিয়েছেন, তাকে অন্যায্য বলে, চরম শুভনাস্তিকেরও সেই সাহস হবে না। তবে কিনা, ২০২২ সম্বন্ধেও তিনি কিছু কথা বলেছিলেন। যেমন, কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে, সবার জন্য বাড়ির ব্যবস্থা হবে। তারও আগে কথা দিয়েছিলেন, ২০১৪ সালে যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তবে দেশের কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে সব ভারতীয়র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে, বছরে দু’কোটি নতুন চাকরির সংস্থান হবে। স্বভাবতই, এই ১৫ অগস্টে প্রধানমন্ত্রী সেই পুরনো প্রতিশ্রুতিগুলির কথা উল্লেখ করেননি। প্রশ্ন হল, ‘জুমলা’ ভেবে সেই প্রতিশ্রুতিগুলি ভুলে যাওয়াই কি বিধেয়? যদি তা-ই হয়, তবে নতুন প্রতিশ্রুতিতেই বা মানুষ ভরসা করবে কোন সাহসে? কেউ বলতে পারেন, অতিমারির ধাক্কায় সব টালমাটাল হয়ে গেল, তা কি প্রধানমন্ত্রীর দোষ? না, তবে অর্থনীতির পরিসংখ্যান বলছে, অতিমারি ও লকডাউনের আগেই ভারতের গতিভঙ্গ হয়েছিল। আরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির আগেই দেশকে দুর্নীতি, ধুলো, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত করা হবে। অতিমারি তো সেই কাজে কোনও বাধার সৃষ্টি করেনি। তা হলে স্বাধীনতা দিবসের যাবতীয় আনন্দকে ম্লান করে ন’বছর বয়সি দলিত শিশুটিকে কেন মরতে হল? কেনই বা ভারতে সংখ্যালঘুদের দুরবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে উদ্বেগ ক্রমবর্ধমান? প্রধানমন্ত্রী এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেবেন, তেমন সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। পঁচাত্তর বছর এখন অতীত— ভারত অতঃপর শতবর্ষের খোয়াবনামা আঁকড়ে বাঁচবে।
যে প্রতিশ্রুতিগুলি রক্ষিত হয়নি, অদূর ভবিষ্যতে হবে, তেমন কোনও লক্ষণও দিগন্তরেখায় নেই, সেগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী নতুনতর প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করলেও মানুষ তাতে কেন বিশ্বাস করবে? কেন পুরনো প্রতিশ্রুতির হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি উঠবে না? কেউ একে প্রধানমন্ত্রীর সম্মোহনী ক্ষমতা বলে ব্যাখ্যা করতেই পারেন। কিন্তু, বাস্তবের জমিতে ম্যাজিকের ঠাঁই নেই। আসলে, শাসকদের কাছে হিসাব চাওয়ার সাহসটি দেয় গণতন্ত্র। পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের পোশাকি গণতন্ত্র নয়— আলোচনার, বিরুদ্ধ মত প্রকাশের, সত্য কথা বলার পরিসরসমৃদ্ধ প্রকৃত গণতন্ত্র। বর্তমান শাসকরা সেই পরিসরটিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছেন, কোথাও লোভ দেখিয়ে, কোথাও ভয় দেখিয়ে। সেই সাফল্যের সুফলই প্রশ্নহীন আনুগত্য রূপে ঘরে তুলছেন তাঁরা। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন করার সাহসটিকে জাগিয়ে তোলাই এই মুহূর্তে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দাবি।