ইউক্রেন-যুদ্ধ নিয়ে কি জওহরলাল নেহরুর দেখানো পথেই হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী? প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ— কেননা, মোদী সরকার ও তার কুশীলবেরা উঠতে-বসতে যে ব্যক্তিকে শাপশাপান্ত করে থাকেন, তাঁর নাম নেহরু। তাঁরা প্রকাশ্যেই বলেন, আজকের দিনের দেশের যাবতীয় বড় সমস্যার বীজ স্বহস্তে বপন করেছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। যোজনা কমিশন থেকে রাষ্ট্রীয় বিকাশ পরিষদ— নেহরুর ভারতের যাবতীয় অভিজ্ঞান বা ভিত্তি মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর তাঁরা। অতএব, সেই সরকার যখন আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার চলমান সংঘাতে পক্ষাবলম্বন না করে কেবলমাত্র পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করে— যা নেহরু আমলের নির্জোট আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়— তখন প্রশ্ন উঠবেই। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েটের হাঙ্গেরি আক্রমণ অথবা ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ— নয়াদিল্লি যখন তার নিন্দা না করে ‘সব পক্ষ’, ‘নিরস্ত’, ‘কূটনৈতিক বিনিময়’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে থাকে, তখন দুইয়ের আপাত সাদৃশ্য সত্যিই অস্বীকার করা যায় না।
এ কথাও অনুধাবনযোগ্য যে, দীর্ঘ ব্যর্থতার পরে এই প্রথম কূটনীতির মঞ্চে মোদী সরকারের পক্ষে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। এক দিকে নর্ডিক দেশগুলির সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকমালায় একাধিক বার স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কথা বলেছে ভারত, অন্য দিকে তেমনই তেল ও শক্তির ব্যাপারে ইউরোপীয় দেশগুলির রুশ-নির্ভরতাকে কটাক্ষও করেছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আর, নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষে স্ব-অবস্থানে স্থিত থাকার সুফলটি অবশ্যম্ভাবী— দুই শিবিরের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভারত। এই মুহূর্তে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেমন ইউক্রেনে নয়াদিল্লির মানবিক সহায়তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তেমনই রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ-ও ‘নিরপেক্ষ বিদেশনীতি’ দৃষ্টান্ত হিসাবে বিশ্বমঞ্চে ভারতের কথা উল্লেখ করছেন। স্মর্তব্য, ১৯৫৬ সালেও সোভিয়েটের সমালোচনা করে ‘লক্ষ মানুষের বিশ্বাস চুরমার’ করার সমালোচনা করেছিল ভারত, অথচ রাষ্ট্রপুঞ্জে আমেরিকা-গৃহীত নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দিতে রাজি হয়নি। আন্তর্জাতিক মঞ্চে নেহরুর ভারত ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে কথা ইতিহাসে লেখা আছে।
তবে, আপাত মিল সরিয়ে রেখে নেহরু ও মোদী জমানার বিদেশনীতির মূলগত ফারাকটি বুঝে নেওয়া জরুরি। নির্জোট আন্দোলনের ভিত্তি আদর্শনৈতিক। দুই যুযুধান বিশ্বশক্তির আনুগত্য আদায়ের প্রতিযোগিতার জটিল আবহে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই তৃতীয় বিশ্বের সদ্য-স্বাধীন দেশগুলির কর্তব্য বলে মনে করতেন নেহরু, তাঁরা তাই কোরীয় যুদ্ধে পক্ষ নিতে অস্বীকার করেছিলেন। বিপ্রতীপে, মোদী সরকারের বর্তমান নিরপেক্ষ নীতি বাস্তবধর্মসঞ্জাত। প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে মস্কোর উপর প্রবল ভাবে নির্ভরশীল নয়াদিল্লি, তদুপরি ক্রেমলিনকে চটিয়ে রুশ-চিন অক্ষকে বিরূপ করে তোলাও যে ভারতের পক্ষে শুভ হবে না, তা-ও তারা অবগত। আন্তর্জাতিক রাজনীতির দড়ি টানাটানিতে ভারত যে এখন প্রবেশ করছে না, তা আপন স্বার্থ বুঝেই, তার পিছনে বৃহত্তর বিশ্বজনীন আদর্শ নেই। উপর-উপর মিল থাকলেও তাই নেহরু আর মোদীর পথ আজও পৃথক।