অতিমারির সব ক্ষতি সমান মাপের নয়, মনে করিয়ে দিলেন অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ়। অর্থব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছিল, তা পূরণ হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষতিও কাল না হোক পরশুর পরের দিন বহুলাংশে পুষিয়ে যাবে। কিন্তু, শিক্ষাক্ষেত্রে যে ক্ষতি হল, দ্রেজ়ের মতে, তা পূরণ হতে লেগে যাবে বহু বছর। মন্তব্যটির অভিঘাত তীব্র, অনেকের কাছেই হয়তো আকস্মিকও— কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা সম্ভব যে, ছবিটি দেখতে না পাওয়াই বরং আশ্চর্যের। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতির চরিত্র এমনই যে, তার পূর্ণ অবয়ব অপ্রশিক্ষিত চোখে ধরা পড়তে চায় না। কিছু ইঙ্গিত বিলক্ষণ মিলেছে— বিভিন্ন সরকারি ও অসরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, প্রায় সব রাজ্যে সব শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা প্রাক্-অতিমারি পর্বের তুলনায় কম শিখেছে; মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতায় নিজের নামটুকুও লিখতে পারেনি অনেক ছেলেমেয়ে; এক ছাত্রীর একটি সাধারণ ইংরেজি বানান বলতে না পারা নিয়ে তোলপাড় হয়ে গিয়েছে গোটা রাজ্য। কিন্তু, এই ক্ষতিও শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক ক্ষতির তুলনায় যৎসামান্য। কারণ, শিক্ষার ক্ষতির ফল শিক্ষার্থীর জীবনের সম্ভাবনাকে সীমিত করে, এবং তার পাশাপাশি তা প্রজন্মের গণ্ডিও অতিক্রম করে; সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার উপর বিষম প্রভাব ফেলে।
অতিমারির কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষা প্রথমে প্রায় সম্পূর্ণত ডিজিটাল হয়েছিল; পরিস্থিতি ক্রমে ‘নতুন স্বাভাবিক’-এ পৌঁছনোর পর যে ব্যবস্থা চলছে, তাকে বলা হচ্ছে হাইব্রিড— অর্থাৎ, অনলাইন ও অফলাইনে মিলিয়েমিশিয়ে লেখাপড়া চলছে। এই ডিজিটাল বিভাজিকায় যে অসাম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা বহু-আলোচিত। বিশেষত দরিদ্রতর, এবং প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে এই ব্যবস্থা বিষম হয়েছে— আর্থিক অসাম্য পরিণত হয়েছে শিক্ষার সুযোগের গভীর অসাম্যে। কোনও কল্যাণরাষ্ট্রের কাছে এই অসাম্য সম্পূর্ণ অসহনীয় হওয়ার কথা। বহু ছেলেমেয়ে স্কুলছুট হয়ে গিয়েছে। স্কুলের শিক্ষাটুকু সম্পূর্ণ করলেও তাদের সামনে যে সুযোগগুলি থাকত, স্বভাবতই সেগুলি এই ছেলেমেয়েদের হাতছাড়া হবে। ফলে, তাদের আজীবন অর্থোপার্জনের, সামাজিক চলমানতার সম্ভাবনা কমবে। তার ফল পড়বে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের উপর। ফলে, তাদেরও উন্নয়ন ও সামাজিক চলমানতার সম্ভাবনা সীমিত হবে। আন্তঃপ্রজন্ম ক্ষতির আর একটি পথ হল, এই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ নিয়েই যাঁরা ভবিষ্যতে শিক্ষক হবেন, তাঁদের শিক্ষকতার গুণগত মান খাটো হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এবং তা ভবিষ্যতের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষতি করবে। সার্বিক ভাবে শিক্ষার ক্ষতি হলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের উপরেও।
অর্থাৎ, অতিমারি ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রের যে ক্ষতি করেছে, শুধুমাত্র সময়ের হাতে ছাড়লে তা পূরণ হওয়া অসম্ভব। স্কুল-কলেজ যদি পুরনো, ‘স্বাভাবিক’ ছন্দে চলতেও থাকে, ব্যবস্থা থেকে ছিটকে যাওয়া ছেলেমেয়েদের তাতে ফিরে আসার রাস্তা বন্ধ। বস্তুত, ‘নতুন স্বাভাবিক’ হাইব্রিড ব্যবস্থা আরও অনেক ছেলেমেয়েকে ছিটকে দেবে, তেমন সম্ভাবনা প্রবল। ভারতীয় রাষ্ট্রকে দেখলে ভরসা হয় না যে, এই অবস্থা তার কাছে অসহনীয় ঠেকবে। তাই আলাদা ভাবে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। প্রথমে দরকার ক্ষতির প্রকৃত অডিট। প্রতিটি ছাত্রের ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে দেখতে হবে যে, তার কত ক্ষতি হয়েছে, এবং কোন পথে সেই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব। ব্রিজ কোর্স, ডিজিটাল সহায়তা, বিশেষ প্রশিক্ষণ বা আর্থিক সাহায্য, যা প্রয়োজন, তা-ই দিতে হবে। অতিমারি-উত্তর পৃথিবীর চাহিদার কথা মাথায় রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজতে হবে। কিন্তু, সবার আগে স্বীকার করতে হবে যে, খুব ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।