সরকারি কর্মীদেরও যে বেতন বৃদ্ধি প্রয়োজন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রতীকী ছবি।
রাজনীতির এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে— অহেতুক তরজায় জড়িয়ে তা মূল প্রশ্নটিকে বেমালুম ভুলিয়ে দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কার্যত প্রতিটি মুহূর্তই সেই অনন্ত তরজার সাক্ষী। এখন যেমন রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা নিয়ে বিস্তর কুতর্ক চলছে। মুখ্যমন্ত্রী রাজনীতির অস্ত্রে সেই মহার্ঘ ভাতার প্রশ্নটিকে নামিয়ে এনেছেন দর কষাকষির খেলায়। আপাতত তিনি আরও তিন শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিতে রাজি হয়েছেন। তার পরে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যাতে মনে হয় যে, কর্মীরা আরও কতখানি wভাতা আদায় করে নিতে পারেন, তা প্রধানত নির্ভর করছে তাঁদের দর কষাকষির রাজনৈতিক শক্তির উপরে। কর্মীদের ভাতার অঙ্ক নির্ধারিত হয় বেতন কমিশনের হিসাব অনুসারে, তা দর কষাকষির বিষয় নয়। মুখ্যমন্ত্রী যদি সেই আইনকে ন্যায্য বলে বিবেচনা করেন, তা হলে তার উপরে আর তর্ক চলে না। মুখ্যমন্ত্রী যে প্রশ্নটি করেননি, এবং রাজনৈতিক তরজা যে প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ গুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, তা হল, মহার্ঘ ভাতার ব্যবস্থাটি কি আদৌ ‘ন্যায্য’? এই ব্যবস্থার সূত্রপাত বম্বের কটন মিলগুলিতে, গত শতকের প্রথমার্ধে। মালিক পক্ষের সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনগুলির সুদীর্ঘ সংঘাতের ফল ছিল এই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থার সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ব্যবস্থাটি সরকারি নীতিতে গৃহীত হয়। তার পর একের পর এক বেতন কমিশন ভাতার অনুপাত স্থির করেছে, প্রদানের প্রণালী নির্ধারণ করেছে। কিন্তু, রাজনীতি যে-হেতু বড় বালাই, ফলে কেউ প্রশ্ন করেনি যে, এই ভাতা আদৌ দেওয়া হবে কেন? লক্ষণীয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু সেই প্রশ্নটি করছেন না।
প্রশ্নটি করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত প্রত্যক্ষ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেয়। রাজ্য সরকার তার উপরে স্কুলশিক্ষক-সহ আরও বেশ কিছু সরকার-পোষিত কর্মচারীকে মহার্ঘ ভাতা দেয়। হিসাব বলছে, ভারতে শ্রমশক্তির মোট আয়তন যেখানে নব্বই কোটি, তার মাত্র ২.২ শতাংশ সরকারি চাকরি করেন। অর্থাৎ, দেশে প্রতি একশো জন কর্মরত ব্যক্তি মধ্যে আটানব্বই জনের জন্যই কোনও মহার্ঘ ভাতা নেই। বাজারে মূল্যবৃদ্ধি অবশ্য সবার জন্যই সমান। কোনও ব্যক্তি সরকারি চাকরি করেন, শুধুমাত্র সেই কারণেই মূল্যবৃদ্ধির আঁচ থেকে তাঁকে রক্ষা করার বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে, এবং তা সেই কর্মীদের ‘অধিকার’ হিসাবে পরিগণিত হবে, এই ব্যবস্থাটির অন্যায্যতার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা জরুরি। সরকারি কর্মীদের বর্ধিত হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে, না কি সেই টাকা ব্যয় করা হবে সর্বজনীন উন্নয়নের খাতে, অথবা গরিব মানুষের হাতে নগদ পৌঁছে দিতে— সেই বিবেচনাটি জরুরি। সরকারি কর্মীরা সমাজের নিরাপদতম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের স্বার্থরক্ষার চেয়ে প্রান্তিক, বিপন্ন মানুষের স্বার্থরক্ষা রাষ্ট্রের অধিকতর কর্তব্য কি না, সেই আলোচনাও জরুরি। এটা সুবিধাবাদের প্রশ্ন নয়, রাজনৈতিক ন্যায্যতার প্রশ্ন। দুর্ভাগ্য যে, শাসক বা বিরোধী, কোনও পক্ষই ক্ষুদ্র রাজনীতির গণ্ডি অতিক্রম করে এই প্রশ্নগুলিতে পৌঁছতে পারেন না।
সরকারি কর্মীদেরও যে বেতন বৃদ্ধি প্রয়োজন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু, কর্মদক্ষতা, উৎপাদনশীলতা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা— কোনও বিবেচনা ব্যতিরেকে নিয়মিত ব্যবধানে বেতন বৃদ্ধি ঘটলে উৎপাদনশীলতার ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়, যার স্বরূপ ভারতের প্রতিটি সরকারি দফতর জানে, সেখানে পরিষেবার আশায় যাওয়া সাধারণ মানুষ জানেন। মহার্ঘ ভাতা তো বটেই, বেতন কমিশনের ব্যবস্থা নিয়েও একই প্রশ্ন করা প্রয়োজন— কোন যুক্তিতে সরকারি কর্মীরা দেশের আটানব্বই ভাগ কর্মীর চেয়ে আলাদা হবেন, কেন তাঁদের কাজের পরিমাণ ও গুণগত মানের সঙ্গে বেতনের ন্যূনতম সম্পর্কটুকুও থাকবে না? রাজনীতির ঘোলা জল নিশ্চিত করেছে যে, এই প্রশ্নগুলি উত্থাপিতই হবে না। হাতে থাকবে শুধুই তরজা।